২০২৬ সালের এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও প্রস্তুতি শেষ হলে তা এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতেও আনা সম্ভব; লন্ডনে বৈঠকে তারেক রহমানকে একথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শুক্রবার যুক্তরাজ্যে দুজনের বহুল আলোচিত বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে একথা জানানো হয়।
আগামী নির্বাচনের সময় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির টানাপড়েনের মধ্যে লন্ডনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে নজর ছিল দেশের সবার।
বিএনপি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। ড. ইউনূস ভোটের সময় হিসাবে ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা বলে আসছিলেন।
তবে সম্প্রতি ড. ইউনূস ঘোষণা দেন যে এপ্রিলে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছেন তারা। তবে তার সেই ঘোষণাও প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব করেন।
তারেক বলেন যে তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
এই বছর মার্চ মাসজুড়ে রোজা ছিল। সেক্ষেত্রে আগামী বছর রোজা শুরুর সম্ভাব্য সময় ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। তারেকের প্রস্তাব অনুযায়ী ভোট করতে হবে ফেব্রুয়ারি প্রথম ভাগে। এই প্রস্তাব জামায়াতে ইসলামীও আগে দিয়েছিল।
তারেকের প্রস্তাব শুনে ড. ইউনূস বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
“সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের (জুলাই হত্যাকাণ্ডের) বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
ড. ইউনূসের কথা অনুযায়ী রোজার আগে ভোট করা যাবে েফব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে।
যৌথ বিবৃতির বক্তব্যে দুই পক্ষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগেই বলেছিলেন, এই বৈঠক হতে পারে রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট’। আর বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফেইসবুকে লিখেছেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের আবাসস্থল ডরচেস্টার হোটেলে দেড় ঘণ্টার এই বৈঠক শেষে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “অত্যন্ত সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশে তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
“জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই (নির্বাচন নিয়ে) অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও জনাব তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার ঘোষণা তখন দিয়েছিলেন তারেক।
এরপর নানা বিষয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ ওঠে তুঙ্গে।
পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার থেকে দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে সরানোর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে তোলে বিএনপি।
তার মধ্যে ড. ইউনূস লন্ডন সফরে গেলে সরকারের উদ্যোগেই তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের আয়োজন হয় বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বৈঠকে অংশ নিতে লন্ডন সময় পৌনে ২টার দিকে ডরচেষ্টার হোটেলে পৌঁছান তারেক রহমান। গাড়ি থেকে নামলে তাকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কর্মকর্তারা।
হোটেল লবিতে তারেক রহমানকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে প্রধান উপদেষ্টার কক্ষে নিয়ে যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, যাকে সরানোর দাবি বিএনপি জানিয়ে আসছে।
তারেক রহমানের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তার সঙ্গে খলিল রহমানের বসে থাকার একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে।
বৈঠক শুরুর আগে কুশল বিনিময় তারেক রহমান ও ড. ইউনূস। তারেক রহমান বলেন, তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘সালাম’ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টাকে। তখন ড. ইউনূসও ধন্যবাদ জানান। আলোচনা শুরুর আগে তারা লন্ডনের আবহাওয়া নিয়েও কথা বলেন।
তারেক একটি ‘ওয়াটারম্যান’ কলম ও দুটি বই ড. ইউনূসকে উপহার দেন। বই দুটির একটি হচ্ছে ‘নেচার ম্যাটারস’ নামের একটি কবিতা সংকলন, অন্যটি জলবায়ু আন্দোলনের সংগঠক গ্রেটা থুনবার্গের লেখা ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেইক আ ডিফরেন্স’।
তারেকের সঙ্গে তার আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরও ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে খলিলুর রহমানের পাশাপাশি প্রেস সচিব শফিকুল আলমও ছিলেন।
বৈঠক শেষে পৌনে ৪টার দিকে হোটেল ছাড়েন তারেক রহমান। তিনি গাড়িতে ওঠার আগে হোটেলের সামনের সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার পর কোনও সরকারপ্রধানের সঙ্গে এটাই তার প্রথম বৈঠক।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার পর গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তারেক। জামিনে মুক্তির পর পরের বছর স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তিনি লন্ডন যান। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ শাসনামলে চারটি মামলায় তার কারাদণ্ড হয়।
গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মামলাগুলো থেকে খালাস পান তারেক। এরপর খালেদা জিয়া লন্ডন গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে গত মাসে দেশে ফিরলেও ফেরেননি তারেক, তবে তার স্ত্রী জোবায়দা রহমান ফিরেছেন।
তারেকের না ফেরার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের নেতা দেশে ফেরার পরিবেশ এখনও হয়নি।