Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৫

ডাক্তার না হয়ে ফুটবলার, এরপর মহানায়ক পিন্টু

pintu1
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশ জন্মের আরেক ইতিহাস জাকারিয়া পিন্টু ধরাধামের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তার এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলাম। তারই চুম্বক অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে প্রয়াত ফুটবল নায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।  

শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হয় না, হাতিয়ার হতে পারে ফুটবলও! ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল করে দেখিয়েছে সেটাই। স্বাধীনতার দাবিতে যখন জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা তখন পাশের দেশ ভারতে ফুটবল খেলে জনমত সংগ্রহ করেছিলেন জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।

১৬টা ম্যাচ খেলে ৫ লাখ ভারতীয় রুপি সংগ্রহ করেছিল তারা, এর পুরোটাই দান করা হয় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। তখনকার ৫ লাখ রুপি বর্তমান সময়ের বাংলাদেশি মুদ্রায় কোটি টাকার ওপরে, যা ছিল অভূতপূর্ব।

এই উদ্যোগের প্রথম ম্যাচটা হয় ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই কৃষ্ণনগরের নদীয়া স্টেডিয়ামে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ ছিল নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে। নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা ম্যাচের আগে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিল।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে দেশের পতাকা হাতে জাকারিয়া পিন্টু ও সতীর্থরা। ছবি : সংগৃহীত

কথা ছিল, জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়ারও। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগে নদীয়ার জেলা প্রশাসক দীপক কান্তি ঘোষ জানিয়ে বসেন আপত্তি। সেটা সংগত কারণেই, কেননা তখনো ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে একজন জেলা প্রশাসক কোনোভাবে পারেন না আরেকটি দেশের পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দিতে।

পতাকা ওড়ানোর অনুমতি না দেওয়ায় ভাঙচুর শুরু হয় গ্যালারিতে। কেননা দর্শকদের বেশির ভাগই ছিলেন বাংলাদেশি। স্বাধীন বাংলা দলের প্রথম খেলা দেখতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভেঙে এসেছিল পুরো মেহেরপুর।

অধিনায়ক হিসেবে তখন এগিয়ে যান জাকারিয়া পিন্টু। দীপক কান্তি ঘোষকে অনুনয় করে বলেন, ‘‘স্যার এক মিনিটের জন্য হলেও পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেন। আমরা কখনও স্বাধীন হলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে। এই যে এত মানুষ এসেছে সীমান্ত পেরিয়ে, সবার চাওয়া এটা।’’

জাকারিয়া পিন্টুর দৃঢ় কণ্ঠের এই অনুরোধ ফেলতে পারেননি দীপক কান্তি ঘোষ। ১০ মিনিটের জন্য মাঠে ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। ভারতের পক্ষে দীপক কান্তি ঘোষ আর বাংলাদেশের হয়ে পতাকাটা ওড়ান জাকারিয়া পিন্টু।

বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার দেশের পতাকা ওড়ানোর সৌভাগ্য কয়জনের হয়? ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে গাইতে দলের কেউই ধরে রাখতে পারেনি চোখের পানি। বন্দুক হাতে লড়াই করতে না পারার যে দুঃখ, সেটা কেটে যায় এরপর।

যুদ্ধ শুধু বুলেটে নয়, ফুটবলেও হতে পারে- জাকারিয়া পিন্টুর দলই প্রথম দেখায় গোটা বিশ্বকে। গগনবিদারী ধ্বনিতে তখন প্রকম্পিত নদীয়া। এটা ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও।

তবে ভারতীয় সরকারের অনুমতি না থাকায় দীপক কান্তি ঘোষসহ বহিষ্কার করা হয়েছিল পুরো নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থাকেও। স্বাধীনতা না পাওয়া একটি দলের বিপক্ষে সরকারের অনুমতি না নিয়ে খেলাই ওদের অপরাধ। পরে অবশ্য উঠে গিয়েছিল সেই নিষেধাজ্ঞা।

প্রথম ম্যাচটা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ড্র করেছিল ২-২ গোলে। গোল ২টি করেছিলেন এনায়েতে ও শাহজান। আসলে জয় বা হারটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তখন। জাকারিয়া পিন্টুরা খেলছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সংগ্রহের জন্য।

নদীয়াকে বহিষ্কারের পর মোহনবাগান খেলে তাদের খ্যাতনামা খেলোয়াড় গোস্টপালের নামে একাদশ গড়ে। প্রতিটি ম্যাচেই পূর্ণ থাকত গ্যালারি। জাকারিয়া পিন্টু, কাজী সালাউদ্দিন, প্রতাপ হাজরা, কায়কোবাদসহ সেই দলের অনেক ফুটবলারের পোস্টার টাঙানো হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন শহরে। স্বাধীনতা-পাগল পিন্টুর এই দলটি নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধারাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন এতে।

উত্তম কুমার, দিলীপ কুমার, সায়রা বানু, শর্মিলী ঠাকুর, খ্যাতনামা ক্রিকেটার মনসুর আলী খান পাতৌদিরা উৎসাহ দিয়েছিলেন সে সময়। পাতৌদি তো ক্রিকেটার হয়েও একটি ম্যাচ খেলেছেন জাকারিয়া পিন্টুদের বিপক্ষে। এরপর তিনি ২০ হাজার রুপি অনুদান দেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে। সে সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমার অনুদান দিয়েছিলেন ৩০ হাজার রুপি। সব তারকাই পিঠ চাপড়ে দিতেন পিন্টুসহ অন্য ফুটবলারদের।

ডাক্তার না হয়ে হলেন ফুটবলার

সেই কিংবদন্তি জাকারিয়া পিন্টুর কিন্তু ফুটবলার হওয়ারই কথা ছিল না। তার ডাক্তার বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকেও ডাক্তার হিসেবে গড়ে তোলার। ১৯৫৬ সালে একদিন জাকারিয়া পিন্টুর স্কুল কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশনে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের স্কুলের সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচ হয়েছিল অফিসার্স ক্লাবের। স্কুলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু আর অফিসার্স ক্লাবের তার বাবা নাজিব উদ্দিন! ম্যাচে ২ গোল করেছিলেন পিন্টু।

বঙ্গবন্ধু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন বাবার মতো পিন্টুও ডাক্তার হতে চান। এরপর তার বাবা নাজিম উদ্দিনকে ডেকে হাতে হাত রেখে ওয়াদা নিয়েছিলেন ছেলেকে যেন ফুটবলার তৈরি করেন। নাজিম উদ্দিন না বলতে পারেননি আর। ১৯৪৩ সালে নওগাঁয় জন্ম নেওয়া মেধাবী ছাত্র জাকারিয়া পিন্টু এরপর হয়ে যান ফুটবলার।

সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেই জাকারিয়া পিন্টু বলেছেন, ‘‘আমার আলাদা রাজনৈতিক আদর্শ আছে। তবে বঙ্গবন্ধু সেদিন বাবাকে ওয়াদা না করালে ফুটবলার হতে পারতাম না কখনও। বাংলাদেশের মানুষের এত ভালোবাসাও পাওয়া হতো না।’’

জাকারিয়া পিন্টুর ফুটবলার হিসেবে শুরুটা ১৯৫৮ সালে। আটান্ন থেকে ষাট- এই তিন বছর খেলেন ওয়ান্ডারার্স আর ইস্ট এন্ডে। ‘৬০ সালে ওয়ান্ডারার্সকে প্রথম বিভাগ চ্যাম্পিয়ন করার পরের বছর থেকেই তিনি মোহামেডানের ফুটবলার।

১৯৬১ সালে মোহামেডানে যোগ দেওয়ার পর ক্লাব ছাড়েননি আর। জেতা সম্ভব প্রায় সব শিরোপাই জিতেছেন এখানে। প্রথম মৌসুমের মতো শেষ মৌসুমেও মোহামেডানের হয়ে জেতেন লিগ শিরোপা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত অধিনায়ক ছিলেন প্রিয় ক্লাবটির।

ডিফেন্সে প্রাচীর গড়ায় অনেকে জাকারিয়া পিন্টুকে ডাকতেন ‘কালাপাহাড়’ নামে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়ক হওয়ার গৌরবটাও বড় অর্জন জাকারিয়া পিন্টুর। স্বাধীনতার দুই বছর পরই জাতীয় দল থেকে অবসর নেন তিনি।

এরপরও জড়িয়ে ছিলেন ফুটবলে

১৯৭৯ সালে জাতীয় দলের কোচ কাম ম্যানেজার ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। লন্ডনে করেছেন কোচিং অ্যান্ড ট্রেনিং কোর্স। জড়িয়েছিলেন বাফুফের সঙ্গেও। ২০০২ সালে হয়েছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টও। লেখালেখিও করেছেন প্রচুর। তার লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে ১০টার মতো।

বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে মালয়েশিয়ার স্টেডিয়ামে হওয়া অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কখনও ভুলেননি পিন্টু। প্রায় ৪০ হাজার দর্শক পিন্টুর দলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল নানা স্লোগান দিয়ে।

 এত দূরে এসে এমন স্লোগানে শরীরে কাঁটা দিয়েছিল সবার। তখন জাকারিয়া পিন্টুর বেশি করে মনে পড়ে পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় বৈষম্যের শিকার হওয়ার কথা। বাছাইয়ের জন্য সে সময় ঢাকা ছেড়ে যেতে হতো লাহোর, করাচি কিংবা রাওয়ালপিন্ডিতে। কোচরা শ্লেষের সঙ্গে বলতেন, ‘‘শালা বাঙ্গাল, চাউল খাতা হে, ফুটবল ক্যায়া খেলে গা।” শরীরে ইচ্ছামতো বুটও চালাত তারা।

সেই দুর্দিন ঘুচে যায় বাংলাদেশ নামের একটি দেশের জন্মে। যার জন্মে আছে জাকারিয়া পিন্টুর স্বাধীন বাংলা দলের বিশাল ভূমিকা। এমন দল আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না পুরো ফুটবল বিশ্বে। তাদের কাছে আজকের ফুটবলের অনেক ঋণ।

হোলগার ওভারম্যান ও বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে সখ্যতা

সাবেক জার্মান ফুটবলার হোলগার ওভারম্যানের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ওভারম্যানের আরেকটি পরিচয় বিখ্যাত কোচ। তার কাছে জাকারিয়া পিন্টু বলেছিলেন একটি ফুটবল একাডেমি গড়ার স্বপ্নের কথা। জার্মান কোচ তার স্বপ্ন পূরণের জন্য দু-হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক ফুটবল সরঞ্জামও পাঠিয়েছিলেন, গাজীপুর একাডেমি গড়ার পরিকল্পনা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।     

এরপর নিজের ক্যারিয়ার আর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নিয়ে তার বন্ধু জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে একটা সিনেমা করতে চেয়েছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। আড়াই কোটি টাকার বেশি বাজেটের ছবিটি যেন অস্কার দৌড়ে থাকে তেমন পরিকল্পনাও ছিল।

তার কথা অনুযায়ী পাণ্ডুলিপিটা এমনভাবে লেখা হয়েছিল, যেন শুরুতে বেকেনবাওয়ার জানতে চাইবেন জাকারিয়া পিন্টুর কাছে স্বাধীন বাংলা দল সম্পর্কে। পিন্টু স্মৃতিচারণা করবেন। সেই পাণ্ডুলিপিটা থাকলেও পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই বেকেনবাওয়ার ও জাকারিয়া পিন্টু।

বেনেকবাওয়ার মারা গেছেন এ বছরের ৭ জানুয়ারি। আর জাকারিয়া পিন্টু পৃথিবীর ওপারের বাসিন্দা হলেন আজ (সোমবার)। ওপারে নিশ্চয়ই পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে জামিয়ে আড্ডা দিবেন দুই ফুটবল মহানায়ক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত