দুজনই বেড়ে উঠেছেন বিকেএসপিতে। জাকের আলী অনিক ছিলেন ক্রিকেটে। আর নাফিসা তাবাসসুম শ্যুটিংয়ে। খেলা আলাদা, ক্যাম্পাস তো একই। দুজনের হৃদয়ের চাওয়া, দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য-সবই এক।
তাই দুই খেলার দুই প্রতিভাবান তরুণ-তরুণীর একে অন্যের প্রতি ভালোলাগা বদলে যায় ভালোবাসায়। দুই হাত চার হয়ে যায় ২০২০ সালে। দিনাজপুরের মেয়ে তাবাসসুম বিয়ে করেন হবিগঞ্জের জাকের আলীকে।
এরপর স্বপ্নগুলো চার দেওয়ালে বন্দী না করে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করতে থাকেন একে অন্যকে। শ্যুটিংয়ে কখনও তাবাসসুম হতাশ হয়ে পড়লে ভালোবাসা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জোগান জাকের।
জাকের যখন বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন জাতীয় দলের কড়া নেড়েও কপাটটা খুলতে না পারার, তখন তাকে ভেঙে পড়তে দেননি তাবাসসুম। সেই ভালোবাসা আর অগাধ বিশ্বাসের জয় হল শেষ পর্যন্ত। মূল জাতীয় দলের হয়ে কাল (সোমবার) ঘরের মাঠে অভিষেকে সব জেদ, হতাশা, ক্ষোভ জাকের ঝেড়েছেন ব্যাট দিয়ে। ৩৪ বলে ৬৮ রানের ইনিংসে চিনিয়েছেন নিজেকে।
জাকেরের স্ত্রী তাবাসসুম সাফল্য পেয়েছেন তারও আগে। আন্তর্জাতিক শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের (আইএসএসএফ) সরাসরি আয়োজিত কোনো প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে প্রথম পদক জিতেছেন নাফিসা তাবাসসুমই।
২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় আইএসএসএফ গ্রাঁ প্রিতে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। তার অবদান আছে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের মিশ্র দলগত ও মেয়েদের দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জেতায়ও।
বাংলাদেশের শুটিংয়ে এই একটা দিক দিয়ে তাবাসসুমই প্রথম। তেমনি জাকেরও গড়েছেন প্রথম হওয়ার একটা নজির। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে টি-টোয়েন্টির এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ৬ ছক্কা মারার রেকর্ড এখন তার।
জাকেরের খেলা দেখতে মাঠে ছিলেন তার বোন ও দুলাভাই। তবে হবিগঞ্জ থেকে আসতে পারেননি স্ত্রী তাবাসসুম ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। না আসলেও জাকেরের খেলা দেখেছেন টেলিভিশনে। তার একেকটা ছক্কায় করতালি আর চিৎকারে ভেসেছে বাড়ির চারপাশ।
এ নিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তাবাসসুম জানালেন, ‘‘জাকেররা পাঁচ ভাই বোন। তাদের চারজনই ক্রীড়াঙ্গনে জড়িত। এমন একটা পরিবারে আসতে পেরে গর্ব হচ্ছে আমার। ববি আপু (বোন) বাদ দিয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে টিভিতে খেলা দেখেছি জাকেরের। স্থানীয়রা তো ঈদের উৎসবই করেছে এলাকায়। ওর জন্য গর্ব হচ্ছে আমার।’’
জাতীয় দলে প্রথমে ছিলেন না জাকের। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘কালো বলে কারও চোখে পড়ে না ছেলেটা।’’ সে সময় জাকেরের ভরসা হয়ে ছিলেন তাবাসসুম,‘‘ও খুব শক্ত মানুষ। তবে মানুষ তো। এত ভালো করেও জাতীয় দলে ডাক না পেলে খারাপ লাগবে সবারই। ওকে বলতাম, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। নিশ্চয়ই স্বপ্ন পূরণ হবে। সেই স্বপ্নটা পূরণ হল অবশেষে।’’
২০২১ সালে বাংলাদেশ গেমসে সোনা জিতেছিলেন তাবাসসুম। হামিদুর রহমান জাতীয় যুব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপেও জিতেছিলেন সোনা। ২০১০ এসএ গেমসে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে শারমিন সোনা জেতার পর এই ইভেন্টে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সাফল্য আসে তাবাসসুমের হাত ধরে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তাবাসসুম সব সাফল্য পেয়েছেন বিয়ের পর। এজন্য জাকেরের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা, ‘‘আমরা দুজনই খেলোয়াড় হওয়ায় একে অন্যকে বুঝি ভালোভাবে। পরামর্শ দিয়ে চেষ্টা করি সাহায্য করার। সময় পেলে আমার খেলার সময় শ্যুটিং রেঞ্জে এসে উৎসাহ দেয় ও। কয়টা পরিবারে এমন হয় বলেন।’’
বিকেএসপি অধ্যায় শেষে একটা সময় হতাশায় ভুগতে শুরু করেছিলেন জাকের আলী। তার সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা নাজমুল হোসেন শান্ত আর মেহেদী হাসান মিরাজ জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হয়ে গিয়েছিলেন। আর তিনি ছিলেন জাতীয় দল থেকে আলোকবর্ষ দূরে। মানসিক অবসাদে ভুগে জাকের ছাড়তে চেয়েছিলেন ক্রিকেটই!
তাবাসসুম এখন ভুলে যেতে চান খারাপ সময়ের স্মৃতিটা,‘‘মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল জাকের। নানা কারণে ভুগছিল মানসিক সমস্যায়। ওকে তখন চিকিৎসার জন্য ভারতে নেওয়া হয়। ওর পরিবার পাশে ছিল। আমিও পাশে ছিলাম। আমার হাতে হাত রেখে, কাঁধে মাথা রেখে ভরসা খুঁজছিল ও। আমিও শ্যুটিংয়ে খারাপ করার সময় এভাবে ওর কাঁধে মাথা রেখে ভরসা খুঁজেছি। জাকের আমার ভরসা হয়ে উঠেছিল। আমিও ওর ভরসা হয়ে সাহস জুগিয়ে গেছি। এসব আর মনে করতে চাই না। কারণ খারাপ সময়টা পেছনে ফেলে মানসিকভাবে দৃঢ় হয়ে উঠেছে ও।’’
জাকের কতটা দৃঢ় হয়েছেন, জানালেন তাবাসসুম নিজেই, ‘‘চট্টগ্রামে একবার বাংলাদেশ টাইগার্সের ক্যাম্পে জাকেরের পিঠ হট ওয়াটার ব্যাগ লিক হয়ে গরম পানিতে পুড়ে গিয়েছিল। তবু ক্যাম্প ছেড়ে যায়নি ও।’’
জাকেরের বাবা শওকত আলী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট। পাঁচ-ভাই বোনের পরিবারে চারজনই খেলাধুলা করেছেন। বোন শাকিলা ববি ছিলেন হবিগঞ্জ জেলা মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। এখন তিনি দৈনিক খবরের কাগজের স্থানীয় প্রতিনিধি।
বিএকএসপির ট্রায়ালে গাড়ি ভাড়া করে ববিই হবিগঞ্জ থেকে সিলেটে নিয়ে গিয়েছিলেন জাকেরকে। আদরের সেই ছোট ভাইকে জাতীয় দলে খেলতে দেখে সংবাদ সম্মেলনে ববি প্রশ্ন করেছিলেন এভাবে,‘‘আপনার ঘরের মাঠে খেললেন, দর্শক খুব উল্লাস করেছে আপনার খেলায়, কেমন লাগছে?’’
জবাবে শুরুতেই জাকের বলেন,‘‘আপু’’! চোখ ছলছল করে উঠে ববির।
সাফল্য পাওয়ার আগে হবিগঞ্জে জাকের পরিচিত ছিলেন বোন শাকিলা ববির ভাই বলেই। কারণ ববি জেলা মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন যথেষ্ট। এরপর তাবাসসুম বাংলাদেশের হয়ে শ্যুটিংয়ে পদক জেতায়-অনেকে চিনতেন তাবাসসুমের স্বামী হিসেবে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা ইনিংসে বদলে যাচ্ছে পরিচয়। ববির পরিচয় এখন জাকেরের বোন, তাবসসুম হচ্ছেন জাকেরের স্ত্রী। তাতেও আপত্তি নেই তাবাসসুমের,‘‘ আমি জাকেরের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি গর্ববোধ করি। ও আমার অহংকার। বাংলাদেশের অহংকার।’’
একটা ইনিংস খেলে জাকের আগমনি বার্তাই শুনিয়েছেন নিজের। তেমনি বুঝিয়েছেন ক্রীড়া পরিবারে বেড়ে ওঠার মহিমা। শুধু জাকের নন, বাংলাদেশের অহংকার তার পুরো পরিবারই।