দশ বছর আগে পাওয়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। বাংলা একাডেমি ‘অগতান্ত্রিক’ ও ‘আমলাতান্ত্রিক’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ায় তার এই পদক্ষেপ।
তার সিদ্ধান্তের নানা রকম প্রতিক্রিয়া এসেছে সোশাল মিডিয়ায়। অনেকই জানতে চাইছিলেন, কেন এমন পদক্ষেপ।
তার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সন্ধ্যায় ফেইসবুকে দীর্ঘ এক পোস্ট দিয়েছেন জাকির তালুকদার। বাংলা একাডেমিকে পাঠানো আবেদন সংযুক্ত করে তিনি লিখেছেন, এটা তার প্রতিবাদের সর্বশেষ ধাপ।
২০১৪ সালে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন জাকির তালুকদার। পুরস্কারের ক্রেস্ট, অর্থের চেক রবিবার ডাকযোগে বাংলা একাডেমিকে পাঠান তিনি।
এরপর রবিবার দুপুরে ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “পাঠিয়ে দিলাম। খুব ভারমুক্ত লাগছে।” পোস্টে সাথে পুরস্কার ফেরত দেওয়ার আবেদনের আংশিক ছবি এবং একটি ব্যাংকের চেকের পাতা যুক্ত করেন তিনি, যে অর্থটি পুরস্কারের মূল্যমান হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি।
তার সেই পোস্ট দেখে অনেকেই অভিনন্দন জানান, করেন নানা মন্তব্য।
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন লেখেন, “পুরস্কার ফেরত দেওয়ায় খুশি হলাম। কিন্তু কারণটা বললে ভালো হতো। অভিনন্দন, প্রিয় জাকির। এই সাহসটা একমাত্র আপনিই দেখালেন।”
কবি ব্রাত্য রাইসু নিজের ফেইসবুক একাউন্টে এক পোস্টে জাকিরকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, “পুরস্কার না নেওয়া সাহিত্যগতভাবে মর্যাদা রক্ষার উপায়। নিয়া ফেরত দেওয়াটা— ১০ বছর পরে হইলেও— বৈপ্লবিক। যেমন বদরুদ্দীন উমর নেন নাই, এর দ্বারা তিনি খারাপ সংসর্গ হইতে নিজেরে বাঁচাইছেন। এইটা এলিট উপায়।”
১৯৭২ সালে বদরুদ্দীন উমরকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
রাইসু লিখেছেন, “জাকির তালুকদার নিয়ে ফেরত দিছেন। এই দিয়া তিনি বাংলা একাডেমির বিরুদ্ধে একটা কার্যকর অ্যাকশন নিলেন। যেইটা বদরুদ্দীন উমর নিছিলেন না। নিলে আজকে এই দশা হইত না বাংলা একাডেমির।”
আরেকজন লেখক ও আইনজীবী রাহাত মুস্তাফিজ লেখেন, “দেশে থাকতে শুনেছিলাম বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য আপনি কোনও তদবির বাকি রাখেননি। এখন সেই আপনি পুরস্কার ফেরত দিচ্ছেন, তাও আবার ‘বাংলা একাডেমি’র মতো বিশাল পুরস্কার! এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ জানার জন্য অপেক্ষা থাকবে।”
এমন নানা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সোমবারের ফেইসবুক পোস্টে জাকির বলেছেন, স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি পুরস্কারবিজয়ীদের নাম পর্যবেক্ষণ করে তিনি লেখেন, “একটি ‘প্যাটার্ন লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন কয়জন আমলা পাবেন পুরস্কার, বাংলা একাডেমির অন্তত একজন কর্মকর্তা পাবেন পুরস্কার, আর মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ পাবেন পুরস্কার।”
তিনি বলছেন, পুরস্কার পাওয়ার পর সর্বশেষ ‘প্রতিবাদের ধাপ’ হিসেবে পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার আগে গত ১০ বছর ধরে বাংলা একাডেমির নানা অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
বাংলা একাডেমির ‘বোধোদয়’ হচ্ছে না দাবি করে জাকির তালুকদার বলছেন, “একাডেমি কোনও সমালোচনায় কান দেয় না। আত্মসমালোচনা করে না। সেইসাথে দেখা যাচ্ছে, কোনো কবি বা লেখকের কাজের ক্ষেত্র বাদ দিয়ে তাকে অন্য ক্যাটেগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়।”
“আলোচনা করেছি, সভা-সমাবেশে এসব কথা বলেছি, পত্রিকায় লিখেছি, ফেসবুকে লিখেছি অনবরত। প্রতিবাদের সর্বশেষ ধাপ পুরস্কার ফেরত দেওয়া। আমার মতো একজন লেখকের এরচেয়ে বেশি আর কোনো সামর্থ্য নেই।”
বাংলা একাডেমির সমস্যা এবং কার্যক্রম নিয়ে ১০ বছরে তিনজন মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান এই কথাসাহিত্যিক।
“তাদের দুইজন প্রয়াত। একজন বর্তমানের ডিজি। তারা কেউ সমস্যাগুলিকে অযৌক্তিক বলেননি। কিন্তু প্রতিকারের চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়নি।”
বাংলা একাডেমি কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচনের দাবি তুলে জাকির তালুকদার বলেন, “২৫ বছর ধরে নির্বাচন দেওয়া হয় না। নির্বাচিত সদস্যের পক্ষে সম্ভব কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় জোরালো ভূমিকা রাখা। কিন্তু সেই সুযোগ বন্ধ করে রেখেছে বাংলা একাডেমি।”
জাকির তালুকদারের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. হাসান কবীর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফেইসবুক সূত্রে আমরা এ খবর জানতে পেরেছি। এছাড়া আমরা এখনও কিছু হাতে পাইনি। পাওয়ার পর বৈঠক করে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।”
‘মুসলমানমঙ্গল’ ছাড়াও ‘পিতৃগণ’ উপন্যাস লিখে সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যে পরিচিতমুখ জাকির তালুকদার। এছাড়া ‘কুরসিনামা’, ‘কবি ও কামিনী’, ‘ছায়াবাস্তব’, ‘কল্পনা চাকমা’ ও ‘রাজার সেপাই’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করা নাটোরের বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার স্নাতক করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে করেছেন স্নাতকোত্তর। পেশায় তিনি চিকিৎসক।