ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে বলকান অঞ্চলের কসাই রাদোভান কারাদজিচের সঙ্গে তুলনা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
বিতর্কিত এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বাইরেও ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম, খুন, নির্যাতনের অভিযোগ থাকার কথাও জানান চিফ প্রসিকিউটর।
বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম।
এদিন সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ৮ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা ও নির্দেশদাতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
তাদের কারাগারে পাঠানোর আবেদন করলে তা মঞ্জুর করে আগামী এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দিয়ে ১৯ ডিসেম্বর পরবর্তি শুনানির জন্য দিন ঠিক করে আদালত।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এবং এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান ছাড়া অন্যান্য আসামিরা হলেন- ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক, বরখাস্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী ও ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন। তাদের বুধবারই এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এছাড়া এ মামলার অন্য দুই আসামি মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা ও ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলামকে আগেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এর আগে গত ২৭ অক্টেবার তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং কারাগার থাকা আসামিদের আদালতে হাজির (প্রডাকশন ওয়ারেন্ট) করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওই আদেশের প্রেক্ষিতে তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলন ঘিরে হত্যাকাণ্ডে এই ৮ জনের সম্পৃক্ততার নানা অভিযোগের পটভূমি ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
যে অভিযোগ মামুনের বিরুদ্ধে
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া জানিয়ে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন তাজুল।
সাবেক এ পুলিশ প্রধানের বিষয়ে তিনি বলেন, “তার নেতৃত্বে গোটা বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে নিরস্ত্র-নিরিহ ছাত্র-জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত, পঙ্গু, চিরস্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি বা অঙ্গহানী করার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।”
সেই কারণে সাবেক এই আইজিপির বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগ তুলে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “তার পরিকল্পা, প্রস্তুতি এবং নির্দেশসহ আইনের যেসমস্ত ধারা প্রযোজ্য, তার বিরুদ্ধে সেসব অপরাধের অভিযোগ তদন্ত সংস্থা পেয়েছে।”
জিয়াকে বলকানের কসাইয়ের সঙ্গে তুলনা
বলকান অঞ্চলের কসাই রাদোভান কারাদজিচের সঙ্গে বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে তুলনা করে তাজুল বলেন, “বলকান কসাইদের মতো বাংলাদেশের কসাই হিসাবে জিয়াউল আহসান হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে নির্যাতন, গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
“তার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার বাইরেও আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময় গুম, খুন, নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।”
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “তিনি (জিয়াউল) বাংলাদেশের গুম, জোরপূর্বক অপহরণ, গুম করে মানুষদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার, হত্যা করে লাশ লুকিয়ে ফেলা, এই কালচারের জনক তিনি।
“আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যারা বিরোধী দলে থেকে কথা বলেছেন, তাদের তিনি একের পর এক অপহরণ করেছেন, গুম করেছেন, বছরের পর বছর আটকে রেখেছেন। সেখানে নিয়ে হত্যা করেছেন, বহু মানুষ এখনও ফিরে আসেনি। তার নেতৃত্বে বিএনপি নেতা ইলিয়াছ আলীকে গুম করে হত্যা করা হয় বলে আমরা জানতে পারি।”
আর যার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় কয়েকশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে এর সঙ্গে যাত্রবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি আবুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন তাজুল ইসলাম।
“তিনি (আবুল হাসান) জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে সঙ্গে সরাসরি জড়িত। যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় কয়েকশ ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সরকার পতনের পরও মানুষ হত্যা করা হয়েছে।”
এছাড়া পুলিশের বরখাস্ত কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল কাফীসহ সাভার অঞ্চলে এক এসপি, এএসপি এবং আশুলিয়া থাকানর ওসির বিরুদ্ধে গুলি করে ছয়জনকে হত্যা এবং পেট্রোল দিয়ে লাশ জ্বালিয়ে ঘটনা ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার অপচেষ্টার অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আশুলিয়াতে ছয়টি ছেলেকে গুলি করে হত্যা করার পর লাশ চ্যাংদোলা করে প্রথমে রিকশাভ্যানে তুলে, তারপর পুলিশের ভ্যানে তুলে পেট্রোল দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, পুলিশ ভ্যানে আন্দোলনকারীরা আগুন নিয়ে লাশগুলো পুড়িয়েছে।”
কান্নায় ভেঙে পড়েন ওসি মাজহারুল
গুলশান থানার তৎকালীন ওসি মাজহারুল হকের বিরুদ্ধে ভুলবশত সাভার থানার ওসি উল্লেখ করে ওই এলাকায় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত বলে ট্রাইব্যুনালের কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তাজুল।
এ সময় কাঠগড়া থেকে বেশ কয়েকবার হাত উচিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাজহারুল। আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, “স্যার যেসব অভিযোগ আমার নামে আনা হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত না। আমার চাকরির জীবনে কখনোই সাভার অঞ্চলে ছিলাম না। আমি গুলশানের ওসি ছিলাম। আমি নির্দোষ, কোনও অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ছাত্রদের পক্ষে ছিলাম। আমার বাচ্চা আছে, পরিবার আছে।”
তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, “আপনি নিরপরাধ হলে আপনার কিছু হবে না, এখানে তো আমরা ন্যায় বিচারের জন্য বসেছি। আপনি নির্দোষ হলে আপনার কোনও সমস্যা হবে না।”
এরপরই ভুল পাল্টিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “ঠিক আছে, উনি গুলশানের ওসি ছিলেন। সেই তথ্য-প্রমাণও আমাদের হাতে এসেছে। সেখানেও বহু নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।”
এরপর গুলশান-নতুন বাজার ও আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকজন ছাত্র-জনতাকে গুলি চালিয়ে হত্যার অভিযোগ তুলে তার সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা মাজহারুল হক জড়িত বলে দাবি করা হয়।
পরে আদালতের বাইরে ওসি মাজহারুলের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “আমরা ক্লিয়ার করেছি, গুলশানে তার নেতৃত্বে কতগুলো হত্যাকাণ্ড হয়েছে, আমি নাম ধরে ধরে বলেছি। আরও হত্যাকাণ্ডের বিবরণ আসছে। তিনি যে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছেন যে, তিনি নির্দোষ, সেটা তিনি না। সব অপরাধীই বলে যে আমি নির্দোষ। সাক্ষ্য কথা বলে।”
এছাড়া অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তাজুল।
এক মাসের মধ্যে দিতে হবে তদন্ত প্রতিবেদন
চিফ প্রসিকিউটর ঘটনা তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুই মাস সময় চাইলে এক মাসের সময় দিয়ে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পরবর্তি শুনানির তারিখ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
এ সময় বিচারকদের উদ্দেশে কাঠগড়ায় দাড়িয়ে জিয়াউল আহসান বলেন, “আমি জুলাই-আগস্টে কোনও কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমাকে আয়না ঘরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা বলা হচ্ছে। আমি কখনোই আয়না ঘরের দায়িত্বে ছিলাম না। আমি একটি টেকনিক্যাল দায়িত্বে ছিলাম।”
তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসানের উদ্দেশে বলেন, “আপনার কথা আমরা শুনবো আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে, তারপরও যদি আপনি কিছু বলতে চান বলতে পারবেন। আপনি রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, এভাবে বললে হয় না। এসব বলার সুযোগ পাবেন।”
পরে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, “যেসব প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো তদন্ত সংস্থা বিচারের উপযোগী করে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে, ডিজিটাল এভিডেন্স, লাইভ এভিডেন্স এমনভাবে আমরা আদালতের সামনে উপস্থাপন করবো, যাতে ক্রিস্টাল ক্লিয়ারভাবে অপরাধীরা জানতে পারবে তার কী অপরাধ ছিল, গোটা বাংলাদেশ, দুনিয়া দেখবে, এ বিচার স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ হয়েছে।”
ট্রাইব্যুনালে আসামিদের মধ্যে জিয়াউল আহসানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এম আই ফারুকী ও নাজনীন নাহার। চৌধরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জাইয়াদ বিন আমজাদ, জসিম উদ্দিন মোল্লার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাহবুবুর রহমান এবং আবুল হাসানের পক্ষে ছিলেন আরাফাত হোসেন।
আসামিদেরপক্ষের আইনজীবীরা উকালতনামা জমা দিলেও শুনানিতে অংশ নেননি। জিয়াউল আহসানের পক্ষে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার সম্পর্কে একটি আবেদন ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়ার কথা বলেন তার আইনজীবী এম আই ফারুকী ও নাজনীন নাহার। কিন্তু প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, এ আবেদন যথাযথ নিয়মন অনুসরণ করা হয়নি।
পরে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে এ আবেদন জানানোর জন্য আসামিপক্ষের আইনজীবীকে নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।