একুশে পদকের সঙ্গে যে অর্থ দেওয়া হবে তা দিয়ে পাঠাগারের জন্য একটি ঘর করতে চান চাঁপাইনবাবগঞ্জের দই বিক্রেতা মো. জিয়াউল হক, যিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দিয়ে আসছেন। গড়ে তুলেছেন ছোট একটি পাঠাগার।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার দেশের ২১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে একুশে পদক দেওয়া হবে। গত মঙ্গলবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা প্রকাশের পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। যাদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তাদের অবদান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে।
এর মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে তালিকায় আছেন প্রত্যন্ত এক গ্রামের পঞ্চম শ্রেণি পাস জিয়াউল হক, যাকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য এই পুরষ্কার দেওয়া হবে। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেকেই প্রশংসা করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের।
“মানুষের পরিচয় তার পেশা বা পোশাকে নয়, মানুষের পরিচয় কর্মে,” এমন মন্তব্য এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পুরস্কারপ্রাপ্তদের পদক দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণপদক, এককালীন চার লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার জিয়াউল হকের একুশে পদক পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার তিন নম্বর দলদলী ইউনিয়নের মুশরিভুজা বটতলা গ্রামে তার বাড়িতে ভিড় করছেন অনেকে। অনেকে ফোন করে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তাকে।
ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এর আগে ২০০৬ সালে জিয়াউল হককে ‘সাদা মনের মানুষ’ পদকে ভূষিত করে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা।
একুশে পদক পাচ্ছেন, কেমন লাগছে- জানতে চাইলে জিয়াউল হক বলেন, “ওই খবর দেখেই আমার হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে, ভালো কিছু দিলে ভালো কিছু পাওয়া যায়। সেই স্বীকৃতিই মনে হয় পেলাম।
“আমার বয়স এখন ৯১ এর কোঠায়। কিন্তু এই খবর শোনার পর আমার বয়স তরুণদের মতো হয়ে গেছে। মনে মনে আরও কাজের উদ্দীপনা পাচ্ছি।”
জিয়াউল হকের প্রথম স্ত্রী সারাবান তহুরা মারা গেছেন আট বছর আগে। দ্বিতীয় স্ত্রী ফরিদা হককে নিয়ে বটতলা গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করছেন তিনি। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
জিয়াউল হকের মূল পেশা দই বিক্রি। আর নেশা দই বিক্রির টাকা দিয়ে বই কেনা। আরও কিছু সমাজসেবামূলক কাজ করেন দই বিক্রির অর্থ দিয়ে। এই নেশাই তাকে এনে দিয়েছে বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা।
আলাপচারিতায় আরও জানা যায়, জিয়াউল হক লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। বাবা তৈয়ব আলী মোল্লা ও মা শরীফুন নেছার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি। ১৯৬২ সালে বিভিন্নভাবে মানুষকে সহযোগিতা করতে শুরু করেন জিয়াউল হক। এই অর্থ আসত তার দই বিক্রির টাকা থেকে। এমন কল্যাণমূলক কাজে তার প্রথম স্ত্রীও উৎসাহ যুগিয়েছেন সব সময়। ১৯৬৯ সালে তিনি গ্রামের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। পাঠাগারটির এখন বিভিন্ন ধরনের ১৪ হাজার বই আছে। তবে সব বই ছোট এই পাঠাগারে রাখা সম্ভব হয়নি। বড় একটা অংশ রাখতে হয়েছে আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে।
৫০ বছরের বেশি সময় আগে প্রত্যন্ত গ্রামে এমন পাঠাগার করার, বিনামূল্যে বই বিতরণের পেছনে কী চিন্তা কাজ করেছিল সে কথা সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন জিয়াউল হক। বলেন, তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষিত হতে হলে শুধু পাঠ্যবই যথেষ্ট নয়। আবার তার এলাকার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠ্যবইও প্রয়োজন। এ জন্যই তিনি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিতেন। বছর শেষে ফেরত নিয়ে আরেক শিক্ষার্থীদের দিতেন। সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া শুরু করার আগ পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি।
জিয়াউল হক জানান, দই বিক্রির টাকায় সংসার চালিয়ে যা থাকত তা দিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানায় পাঠ্যবই ও কোরআন শরিফ দিয়েছেন। এতিমদের দিয়েছেন পোশাক। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে অনেক শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে গেছেন। অসহায় নারী এবং বৃদ্ধদেরও নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
রাজশাহীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদেরও বই দেওয়ার কথা জানিয়ে জিয়াউল হক বলেন, শুধু মানসিক তৃপ্তি পেতেই এসব সমাজসেবামূলক কাজ করেছেন। এজন্য তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীও হয়েছে, যারা তার এ কাজে সহযোগিতা করেন।
সমাজসেবামূলক কাজে অর্থ ব্যয়ের ১৫ বছরের একটা হিসাব জিয়াউল হকের কাছে আছে। সে হিসাবে ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ কোটি ২৭ লাখ ৪১ হাজার ৬৫০ টাকা সহযোগিতা হিসেবে দিয়েছেন জিয়াউল হক।
অনুপ্রেরণা কারা ছিলেন- জানতে চাইলে জিয়াউল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার প্রথম স্ত্রীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল আমার এসব কাজে। দারিদ্রতার মধ্যে তার সমর্থন ছাড়া কখনও এত কিছু করা সম্ভব ছিল না। আট বছর আগে তিনি মারা যান। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীও আমাকে প্রচুর উৎসাহ দেন।”
পরিবারের বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের নাম নেন জিয়াউল হক।
তিনি বলেন, “এছাড়া এনবিআরের একজন কর্মকর্তা, আমার জেলার অনেক মানুষ আমাকে সহযোগিতা করেন। যে সহযোগিতা করেছি তার মধ্যে দেড় কোটি টাকাই দিয়েছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। আর বাকি দুই কোটি টাকা আমার দই ব্যবসা থেকে এসেছে।”
একুশে পদক থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা কীভাবে খরচ করবেন- এমন প্রশ্নে জিয়াউল হক বলেন, “পাঠাগারটিতে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী আসা-যাওয়া করে। বিকালে তাদের বসার জায়গা হয় না। পাঠাগারটি খুব ছোট হয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে পাঠাগারের জন্য একটি ঘর করব।”
জিয়াউল হক একুশে পদক পাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী গর্বিত, আনন্দিত বলে জানিয়েছেন জেলা স্কাউটসের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রশিদ।
তিনি বলেন, “তার পাঠাগারে আমরা অনেকবার গিয়েছি। সেখানে বইও দেওয়া হয়েছে আমাদের। তার সাথে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। একুশে পদকের জন্য মনোনীত হওয়ার খবর পেয়ে আমরা গতকাল বুধবার তার বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।”
গোলাম রশিদ আরও বলেন, “মূলত তার মতো একজন সাদামাটা মানুষ, যিনি সারাজীবন দই ব্যবসায় নিয়োজিত থেকেছেন। নীরবে বই বিলিয়ে এসেছেন গরীব শিক্ষার্থীদের মাঝে। এমন একটি কাজের সম্মাননা হিসেবে একুশে পদক দেওয়া বিরল। আমরা এজন্য আরও বেশি গর্বিত যে এই ইতিহাসটা আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে লেখা হলো। তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্কাউটসের পক্ষ থেকে।”
জিয়াউল হককে একুশে পদকের জন্য যারা নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন দলদলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোজ্জামেল হক। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “জিয়াউল হক সারাজীবন সমাজের প্রতি যে কাজ করে গেছেন, তার জন্য আমরা ভোলাহাটবাসী গর্বিত। আর একুশে পদকের জন্য তাকে নির্বাচিত করায় সংশ্লিষ্টদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।”
জিয়াউল হকের এমন অর্জনে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাদের একজন রাজশাহীর হাসনাত রনী। নিজের ফেইসবুকে পেইজে গতকাল বুধবার একটি পোস্ট দিয়েছেন জিয়াউল হককে নিয়ে তার একটি ছবি দিয়ে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দইয়ের পাতিলের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছেন জিয়াউল হক।
হাসনাত রনী লিখেছেন, “তিনি একজন দই বিক্রেতা! এই বছর সমাজসেবায় #একুশে_পদক পেয়েছেন।
তাঁকে এবং তাঁর বেশভূষা, পেশা ইত্যাদি দেখে অবাক হলেন?
নাম জিয়াউল হক, বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মশুরিভুজা গ্রামে।
তিনি ১৯৬০ সাল থেকে অদ্যাবধি মানুষের মাঝে বই, কাপড়, বাড়ি নির্মাণ সামগ্রীসহ তাঁর সমস্ত কিছু বিলিয়ে চলেছেন। তাঁর বাড়িতে প্রায় ১৫০০০ বইয়ের একটা লাইব্রেরি আছে, যা সকলের জন্য খোলা। ইতোপূর্বে তাঁকে সাদা মনের মানুষ উপাধিও দেয়া হয়েছে।
এবার চেনা গেলো? মানুষের পরিচয় তার পেশা বা পোশাকে নয়। মানুষের পরিচয় কর্মে।
ভালোবাসা দিবসে এই মানুষ এবং এমন মানুষদের প্রতিও ভালোবাসা জানাই।”