Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

চোখ রাঙাচ্ছে জিকা, পরীক্ষার সুযোগ নেই সরকারি হাসপাতালে

Zika
[publishpress_authors_box]

ডেঙ্গুর পাশাপাশি শঙ্কা জাগিয়েছে মশাবাহিত আরেক রোগ জিকা। গত দেড় মাসে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ জন রোগীর সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। অন্যদিকে, অক্টোবরে চারজন রোগী পাওয়ার কথা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ফ্ল্যাভিভাইরাস শুধু এইডিস মশার মাধ্যমে ছড়ালেও জিকা ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতেও ছড়ায় রক্তদানের মাধ্যমে।

ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ থামাতেই সরকার যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান নতুন শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে জিকা ভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকা সংকট।

গত বছরের অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচজন জিকা রোগী শনাক্ত করেছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। তারা বলছে, গত বছর পাওয়া পাঁচজন রোগীর কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখাকে তারা জানিয়েছিল। কিন্তু সরকারের এই সংস্থা সে তথ্য প্রকাশ করেনি। প্রকাশ করেনি আইইডিসিআরও।

অথচ এ নিয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল। দরকার ছিল মানুষকে অবহিত করে এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন পরিস্থিতিতে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হলে জিকা ভাইরাস নীরবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জিকা ভাইরাসের মডেল।

জিকার লক্ষণ

গবেষকরা জানাচ্ছেন, আফ্রিকান ও এশিয়ান– এই দুটি ধরন রয়েছে জিকা ভাইরাসের। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) জানাচ্ছে, তারা জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত যেসব রোগী পেয়েছেন, তাদের সবাই ভাইরাসটির এশিয়ান ধরনে আক্রান্ত।

আইইডিসিআর জানাচ্ছে, জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত শতকরা ৮০ শতাংশের বেলায় এর কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ শতাংশের মাঝে কিছু লক্ষণ থাকে।

জিকা ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ জানতে কথা হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান এবং সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরামের সঙ্গে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, কেউ জিকাতে আক্রান্ত হলে তার জ্বর হবে; তবে জ্বরের মাত্রা থাকবে মাঝারি।

অন্যান্য উপসর্গ সম্পর্কে তিনি জানান, হালকা মাথা ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, কনজাংটিভাইটিস (চোখের সাদা অংশ আবৃত স্বচ্ছ ঝিল্লি, যেটা হলে চোখ লাল হবে), অস্থিসন্ধি ও পেশীতে ব্যথা, শরীরে লালচে ছোপছোপ দাগ দেখা দিতে পারে।

ডা. আরিফা আকরাম বলেন, কেউ জিকায় আক্রান্ত হলে তার তিন থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। এই উপসর্গ থাকে দুই থেকে চার দিনের মতো।

১৯৪৭ সালে আফ্রিকার উগান্ডার জিকা অঞ্চলে বানরের মধ্যে এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়।

বাংলাদেশে ২০১৪ সালে প্রথম জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়। রক্তের নমুনা পরীক্ষা থেকে তখন জিকা শনাক্ত হয় বলে জানানো হয়েছিল আইইডিসিআর থেকে।

আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, এর কোনও চিকিৎসা নেই, ভ্যাকসিন নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গভিত্তিক।

দেশে জিকা আক্রান্ত রোগী কত

শফিউল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গতবছর (২০২৩) ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সময় আমরা প্রথম পাঁচজন রোগী পাই। সে কথা জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে।

“তবে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, সবাই সুস্থ রয়েছেন, সমস্যা হয়নি। আর তাদের বিদেশ যাওয়ারও হিস্ট্রি নেই। অর্থাৎ তারা দেশেই সংক্রমিত হয়েছেন।”

তিনি জানান, জিকা দেশে আগেও ছিল, এখনও রয়েছে। যেহেতু এটা পরীক্ষা করার সুযোগ কম, তাই শনাক্তের হারও কম। তবে ডেঙ্গু শনাক্তে যেসব রোগীর নেগেটিভ আসছে, তাদের জিকা পরীক্ষা করা দরকার।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন সকাল সন্ধ্যাকে জানান, ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত গত দেড় মাসে তারা ১০ জন রোগী পেয়েছেন।

“আজও (২৮ নভেম্বর) আমরা দুজন পেয়েছি। দিন যাচ্ছে রোগী বাড়ছে, প্রতিদিনই বাড়তে থাকে”, বলেন তিনি।

যে ১০ জন রোগী তারা পেয়েছেন তারা সবাই ঢাকার। তবে এদের ভেতরে বিদেশ ফেরত কেউ নেই, নেই একই পরিবারের একাধিক সদস্যও, জানান তাহমিনা।

এই রোগীদের কথাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা (আইইডিসিআর) তাদেরকে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) জানিয়েছি, এটা আমাদের দায়িত্ব।”

এই রোগীদের বর্তমানে অবস্থা জানতে চাইলে তাহমিনা শিরীন বলেন, তারা সবাই সুস্থ আছেন।

জানা যায়, আইইডিসিআর গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে প্রথম চারজন রোগীর তথ্য পায়। সেটা দেশের প্রথমসারির এক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। সেই হাসপাতালে জিকা শনাক্ত হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাদের স্যাম্পল পাঠানো হয় আইইডিসিআরে। সেখান থেকেই তাদের জিকায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে এরপর থেকেই রোগী সংখ্যা বাড়ছে।

আপনাদের নিজস্ব পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হচ্ছে, নাকি হাসপাতাল থেকে নিশ্চিতকরণের পর আপনারা পরীক্ষা করছেন- এই প্রশ্নে তাহমিনা শিরীন বলেন, “কিছু কিছু করপোরেট হাসপাতাল থেকে স্যাম্পল পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালগুলোর নাম বলা ঠিক হবে না।”

সরকারিভাবে জিকা পরীক্ষার সুযোগ নেই

এইডিস মশাবাহিত রোগ জিকা শনাক্ত হয় পিসিআর (পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন) পরীক্ষার মাধ্যমে।

তবে করোনা মহামারিকালে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষার জন্য পিসিআর মেশিন কেনা হলেও দেশের কোনও সরকারি হাসপাতালে জিকা শনাক্তের পরীক্ষা হচ্ছে না বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

এ কথার সত্যতা মেলে আইইডিসিআর পরিচালকের কথায়। সরকারিভাবে কোনও হাসপাতালে এ পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সরকারিভাবে কেবলমাত্র আইইডিসিআরে এ পরীক্ষা হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে নেই।”

সরকারি হাসপাতালগুলোতে কেন নেই- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা তো আমি বলতে পারব না।”

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে আবার জিকা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার ঘটনাকে বড় এক বিপদ হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল।

তিনি মনে করছেন, যত দ্রুত সম্ভব এ নিয়ে সরকারের করণীয় নির্ধারণ করা উচিত।

তবে সেটা কবে হবে- তা নিয়েও সন্দিহান তিনি।

“স্বাস্থ্যের যে অবস্থা…তাতে করে কবে যে তারা কী করবেন…”, বলেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

আইসিডিডিআর,বি আগেই তাদের জানিয়েছিল, তখন কি সরকার থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল- এ প্রশ্ন রেখে আবু জামিল ফয়সাল বলেন, “এদের এই অবস্থা যে কবে শেষ হবে, কবে এরা ব্যবস্থা নেবে, সেটাও আরেক শঙ্কার বিষয়। অথচ এর চিকিৎসা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা উচিত এখনই।”

তার আশঙ্কা, রোগী বাড়বে, আর ব্যবস্থা নিতে দেরি হলে বিপদও বাড়বে।

বিপদ কোথায়

জিকা ভাইরাস সাধারণত মানুষের জন্য খুব বেশি বিপজ্জনক না। কিন্তু কোনও গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে তাকে বিপজ্জনক বলতেই হবে।

ডা. আরিফা আকরাম বলেন, গর্ভবর্তী নারী জিকা আক্রান্ত হলে তার গর্ভের সন্তানের ব্রেইন ডেভেলপ হয় না। আর বয়স্কদের কেউ আক্রান্ত হলে তাদের ‘গুলেন বারি সিন্ড্রোম’ (জিবিএস)-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

জিকা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিরোধমূলক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক হালিমুর রশিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জিকা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তাদের ৮০ শতাংশের কোনও লক্ষণ উপসর্গ থাকে না। মৃত্যুহার কম, এমনিতেই ভালো হয়ে যায়।”

কিন্তু জিকা প্রতিরোধের জন্য কী করা হচ্ছে– প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের গাইডলাইন রয়েছে, সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত