সরকার প্রধান হিসাবে দ্বিতীয়বার জাতিসংঘে ভাষণ দিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস; সংস্কারের পাশাপাশি বাংলাদেশে গণতন্ত্র উত্তরণের পথে তার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের খবর দিলেন তিনি; বিশ্ববাসীকে জানালেন, ফেব্রুয়ারিতেই হবে নির্বাচন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণ দেন।
এদিনের অনুষ্ঠান সূচি অনুযায়ী ১০ম রাষ্ট্রনেতা হিসাবে ভাষণ দেন তিনি।
ভাষণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টিও বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেন।
তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভাষণের আগেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ড. ইউনূস তার ভাষণে গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাবেন।
“এক্ষেত্রে মূল বার্তা হলো- আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি হবে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য এবং উৎসবমুখর নির্বাচন।”
ড. ইউনূস সাধারণ পরিষদে তার গত বছরের ভাষণের সঙ্গে এই বছরের তুলনা করে বলেন, “গত বছর আপনাদের এই মহান সভায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম সদ্য গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত একটি দেশের রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা আপনাদের শোনানোর জন্য। আজ আমি এই রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি তা বলব।”
তিনি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “এই বছর আমরা ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’র প্রথম বার্ষিকী পালন করেছি, যে অভ্যুত্থানে আমাদের তরুণ সমাজ স্বৈরাচারকে পরাভূত করেছিল, যার ফলে আমরা বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অভিযাত্রা নতুনভাবে শুরু করতে পেরেছি।
“সেই বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে ও আমার সহকর্মীদের। ভেঙেপড়া রাষ্ট্র কাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের। যে বিপুল জনসমর্থনের মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পেয়েছিলাম, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্যে সহজ পথ ছিল নির্বাহী আদেশে সংস্কার কাজগুলো করা। কিন্তু আমরা বেছে নিই কঠিন পথ—অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ।”
১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশনের সংস্কারের সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে এই সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে যেই দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনও অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।”
নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তার সরকারের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নকে রাখার কথা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে জবাবদিহিতা ছাড়া যে কোনও উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু যে অর্থনীতির উপরই চাপ বাড়ায় তা নয়, তা জনগণের কোনও কল্যাণও করে না।”
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া আমরা পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হব না।”
তাই যেসব দেশে এই সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে, তাদের তা ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
প্রযুক্তি যাতে সবার ব্যবহারের জন্য উন্মৃক্ত থাকে, বিশ্বে সেই পরিবেশ তৈরির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “অন্যথায় বিশ্বব্যাপী এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যারা নিজেদের বঞ্চিত, প্রান্তিক, অন্যায় ও অবিচারের শিকার হিসাবে বিবেচনা করবে।”
ড. ইউনূস বলেন, “প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে আমরা ক্ষুদ্রঋণের ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। তখন সেটি ছিল প্রথাগত ধারণার বিরুদ্ধে এক বৈপ্লবিক নিরীক্ষা, কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী তা মূলধারার হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত। ক্ষুদ্রঋণ, লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে।
“বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে আমরা আজ ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণা প্রসার করছি। এটি এক ব্যবসা যার সম্পূর্ণ মুনাফা সামাজিক কল্যাণেই পুনর্বিনিয়োগ করা হয়। ‘সামাজিক ব্যবসা’ প্রমাণ করছে যে প্রতি মানুষের উদ্যোক্তা সত্ত্বা সামাজিক কল্যাণে ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানো সম্ভব।”
বর্তমান বিশ্বে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনও চলমান রয়েছে।
“এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘ডিপফেক’র প্রসার, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
ড. ইউনূস আরও বলেন, “বর্তমানের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ব বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদের উত্থান। আমাদের সময়ে আমরা দেখেছি বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের সুফল মাত্র তিন দশকে ১০০ কোটির মতো মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করেছে। এখন যদি আমরা উল্টো পথে হাঁটি, তবে আমাদের সন্তানদের আর সেই সুযোগ থাকবে না।”
রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটি যে শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, তা নয়, বরং বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে।
“রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সমাধান এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। তার জন্য পূর্ণাঙ্গ জাতীয় রাজনৈতিক মীমাংসার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। রাখাইনের সমস্যাগুলোর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করাও অপরিহার্য। তবে এর জন্য রাখাইন অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সকল জাতিসত্ত্বার অংশগ্রহণে এমন একটি বন্দোবস্তু প্রয়োজন যেন রোহিঙ্গারা সমঅধিকার ও নাগরিকত্বসহ সমাজের অংশ হতে পারে।”
রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য বাংলাদেশকে তহবিল জোগানোর আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মাকিন ডলারে নামতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে নিমজ্জিত করবে, যা তাদেরকে আগ্রাসী কোনও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে। তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে, যা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই আমি বিদ্যমান দাতাদের সাহাজ্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়।”
আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তবসম্মত আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “শিশুরা না খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে।
“জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সাথে আমরাও একমত যে আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে; আমাদের দূর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই সঙ্কটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে বাংলাদেশের সমর্থনের কথা জানান তিনি।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা এককভাবে কোনও দেশের পক্ষে সম্ভবপর নয় জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “একই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান পৃথিবীতে কোনও একটি দেশ সঙ্কটে পড়লে অথবা বিশ্বের কোনও এক প্রান্তে সঙ্কট দেখা দিলে সমগ্র বিশ্বের নিরাপত্তাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়।
“আমাদেরকে তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তরুণরা তিন শূন্য বাস্তবায়নের সৈনিক হয়ে বড় হবে। তাদের সামনে থাকবে শূন্য কার্বন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব- এর ভিত্তিতে তারা গড়ে তুলবে তাদের পৃথিবী।”