দেশে দেশে বাড়ছে খাবারের দাম। নতুন এক গবেষণায় বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়া এখন গোটা বিশ্বের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক সমাজে আরও বিস্তৃত পরিসরে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
বার্সেলোনা সুপারকম্পিউটার সেন্টারের গবেষক ম্যাক্সিমিলিয়ান কটজের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা বলছে, সম্প্রতি কয়েক বছরে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ দেখা গেছে। ব্রিটেনে আলু ও ব্রাজিলে কফির দাম এতটাই বেড়েছে যে, ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত এমন নজির ইতিহাসে ছিল না।
দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ তাপমাত্রা কীভাবে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলছে এবং তাতে দাম বাড়ছে, এনিয়ে আগেও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু নতুন এই গবেষণায় ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর ১৮টি দেশের ১৬টি দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে স্বল্পমেয়াদে অতিরিক্ত গরম, খরা কিংবা ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে খাদ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আগস্টের তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাঁধাকপির দাম ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ছিল।
একইভাবে ইতালি ও স্পেনে ২০২২ ও ২০২৩ সালে দীর্ঘমেয়াদি খরার পর ইউরোপে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জলপাই তেলের দাম এক বছরের ব্যবধানে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। আর মেক্সিকোতে গত দশকের অন্যতম ভয়াবহ খরার কারণে ওই সময়ে ফলমূল ও শাকসবজির দাম অনেকটা বেড়ে যায়।
জাপানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে চালের দাম ৪৮ শতাংশ বেড়ে যায়। ওই সময় চলছিল তীব্র তাপপ্রবাহ। ১৯৪৬ সালে চালু হওয়া আঞ্চলিক রেকর্ড অনুসারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গরম পড়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। এর আগে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মও ছিল একই রকম গরম।
ঘানা ও আইভরি কোস্ট বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ শতাংশ কোকো উৎপাদনের জন্য পরিচিত। কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুতে এই দুই দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি গরম ছিল। এর প্রভাবে ওই বছরের এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী কোকোর দাম হঠাৎ করে ২৮০ শতাংশ বেড়ে যায়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সাধারণত স্বাস্থ্যকর খাবারের দাম অস্বাস্থ্যকর খাবারের চেয়ে বেশি হয়। ফলে খাদ্যের দাম বেড়ে গেলে দরিদ্র পরিবারগুলো ফলমূল ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেয়। এর ফলে অপুষ্টি, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের মতো সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এটি সমাজে নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
চরম আবহাওয়ার কারণে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যায়। আর এতে অনেক সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক বিপর্যয় হতে পারে বলে গবেষকরা সতর্ক করেছেন।
জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চে কর্মরত গবেষক কটজ বলেন, “যতদিন না আমরা নিট-শূন্য নির্গমনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছি, ততদিন চরম আবহাওয়া আরও খারাপ হবে। ইতোমধ্যে তা আমাদের ফসলের ক্ষতি করছে এবং বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
তিনি বলেন, “মানুষ এ বিষয়টা উপলব্ধি করছে। তাদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রভাবগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি। প্রথম অবস্থানে রয়েছে চরম তাপমাত্রা।”
নতুন গবেষণার ফলাফল বিশ্বব্যাপী কৃষিখাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ক্রমবর্ধমান গবেষণালব্ধ তথ্যভাণ্ডারে নতুন মাত্রা যোগ করছে বলে মনে করছেন যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক টিম বেন্টন। যদিও তিনি এই গবেষণায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না।
টিম বেন্টন বলেন, “খাদ্যের সরবরাহে ঘাটতি হলে তার প্রভাব বাজারে পড়ে। যারা খাদ্য কিনে খায় তাদের জন্য দাম বেড়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, এই খাদ্যপণ্যের দামের প্রভাব আরও তীব্র হয়ে ওঠে যখন বিশ্বব্যবস্থা হয় টানাপোড়েনে ভরা, বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকে কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে চাপে ফেলে।”
তিনি বলেন, “আমরা এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা হয়ে উঠছে নতুন স্বাভাবিক, এবং তা দীর্ঘমেয়াদি ‘জীবনযাত্রার ব্যয়সংকট’-এ পরিণত হচ্ছে। যতদিন আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হব, ততদিন এই ধরনের প্রভাব আমাদের সবার ওপর আরও ভয়াবহভাবে পড়তে থাকবে।”
গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন বিশ্ব নেতারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ‘জাতিসংঘ ফুড সিস্টেমস সামিট স্টকটেক কনফারেন্স’-এ অংশ নেওয়ার। সম্মেলনটি ২৭ জুলাই ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থার সামনে থাকা হুমকি নিয়ে আলোচনা করবেন বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতারা।
তথ্যসূত্র : সিএনএন।