Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

রপ্তানি আয়ের হিসাবে এখনও ৪০০ কোটি ডলার গরমিল

চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য। ফাইল ছবি
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার বোঝাই পণ্য। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় গলদ ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখন অভিযোগ ছিল, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে।

গত বছরের জুলাইয়ে তা নিয়ে শোরগোলের পর ইপিবি রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করাই বন্ধ করে দেয়। জানানো হয়, এখন থেকে পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ের ‘প্রকৃত’ তথ্য প্রকাশ করা হবে, তার জন্য দুই-তিন মাস সময় লাগবে।

তার পরের মাসেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ড. মুহাম্মদ ইঊনূসের নেতৃত্বে আসে অন্তর্বর্তী সরকার।

এরপর ৯ অক্টোবর ইপিবি চার মাসের (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করে। সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ করে ইপিবি। সেখানে একই রপ্তানির তথ্য একাধিকবার হিসাব করা হয়েছিল বলেই গরমিল দেখা দেয়।

ইপিবি, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য সমন্বয় করে এখন থেকে প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

তারপর একটি অর্থ বছর শেষ হলেও পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান নিখুঁত হয়নি; রয়েই গেছে সেই গরমিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের ব্যবধান এখন প্রায় ৪০০ কোটি (৪ বিলিয়ন) ডলার।

গত ৩০ জুন শেষ হয় ২০২৪-২৫ অর্থ বছর। ২ জুলাই ইপিবি ওই আর্থিক বছরের রপ্তানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ৩৯ লাখ (৪৮.২৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট-বিওপি) তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি ৮০ লাখ (৪৩.৯৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এ হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ইপিবি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের রপ্তানি আয়ের যে হিসাব দিয়েছে, তার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ৪৩২ কোটি ৫৯ লাখ (৪.৩২ বিলিয়ন) ডলার কম।

এত শোরগোলের পরও সেই হিসাবে বিশাল গরমিল এখনও থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। ফাইল ছবি

গত বছরের জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ের হিসাবে গরমিল নিয়ে যে সমালোচনা হয়, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্যে বড় ফারাক দেখেই হয়েছিল।

পণ্য রপ্তানির তথ্যে গরমিলের বিষয়টি গত বছরের ৩ জুলাই সামনে এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, এত দিন ইপিবির পরিসংখ্যান ধরে রপ্তানির হিসাব করা হতো। তবে সে অনুযায়ী দেশে রপ্তানি আয় আসছিল না। এনিয়ে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা থেকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এখন থেকে প্রকৃত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।

তখন দেওয়া দুই হিসাবের তুলনা করে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির পণ্য রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে গরমিল দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৮১ কোটি (প্রায় ১১ বিলিয়ন) ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি আয় হয় ৪ হাজার ৭৩ কোটি (৪০.৭৩ বিলিয়ন) ডলার, যা আগের অর্থ বছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কম।

যদিও ইপিবি দাবি করেছিল, ওই ১১ মাসে (জুলাই-মে) রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫ হাজার ১৫৪ কোটি (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি।

তবে পরে সংস্থাটি জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে (১২ মাসে) ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি (৪৪.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয় ৪০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।

তার মানে ওই অর্থ বছরে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ে ৩৬৬ কোটি (৩.৬৬ বিলিয়ন) ডলার বেশি দেখিয়েছিল ইপিবি। সে সময় দেখা যায়, তিন অর্থ বছরের ৩৪ মাসে এনবিআরের চেয়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি (২২.৬১ বিলিয়ন) ডলারের রপ্তানি আয় বেশি দেখায় ইপিবি।

ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ইপিবির তথ্যে একই রপ্তানির পরিসংখ্যান বারবার দেখানোসহ কয়েকটি কারণে আয় বেশি দেখাচ্ছিল।

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয় শুল্কায়নের পর। সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভাণ্ডারে তা নথিভুক্ত হয়। স্থানীয় রপ্তানি (দেশের অভ্যন্তরে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও সরঞ্জাম সরবরাহ), নমুনা রপ্তানি ও প্রকৃত রপ্তানি—এই তিন ধরনের হিসাব থাকে এনবিআরে তথ্যভাণ্ডারে। রপ্তানি হওয়া পণ্য থেকে কত আয় দেশে আসে, তার হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়।

এনবিআর ও ইপিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনবিআরের কাছ থেকে হিসাব নিয়ে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে ইপিবি। এই পরিসংখ্যানের মধ্যে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির হিসাবও থাকে। সেগুলো বাদ দিলে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য মিলবে।

তবে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানির আলাদা কোনও কোড না থাকায় সেগুলো আলাদা করতে পারেন না ইপিবির কর্মকর্তারা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ভবন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ভবন।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা তখন বলছিলেন, রপ্তানির ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতি-নির্ধারকরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেগুলো পরে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রপ্তানির হিসাব সঠিক না হলে ভবিষ্যতে এমন সঙ্কট আরও আসবে।

এখন তথ্যে গরমিল থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এত কিছুর পরও ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কেন ব্যবধান হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। এটা মোটেও কাম্য নয়।

“পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানের আগের ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। এখনও কেন ভুল-ত্রুটি হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন হওয়া দরকার।”

মাহমুদ বলেন, “পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে নীতি প্রণয়নে ভুল হবে, এটাই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক নীতিমালা লাগবে, তবে তথ্য পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে সেগুলো যথাযথ হবে না। এমনকি ব্যবসা সম্প্রসারণ ও লক্ষ্য নির্ধারণেও মারাত্মক ভুল হতে পারে।”

এনিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পণ্য রপ্তানি ও রপ্তানির আয় প্রত্যাবাসনের মধ্যে বড় ব্যবধান এখনও থাকায় সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

“ফলে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ রপ্তানি যথাযথভাবে নজরদারি করতে হবে। কোন ক্রয়াদেশের বিপরীতে অর্থ আসছে না, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।”

জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গাইডলাইন মেনে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রতি মাসে প্রকাশ করছেন।

তাহলে গরমিল থাকছে কেন- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এই রপ্তানির মধ্যে স্থানীয় রপ্তানির হিসাব যুক্ত রয়েছে কি না, সেটি আমরা খতিয়ে দেখব। যদি কোনও ত্রুটি থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই সংশোধনের উদ্যোগ নেব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত