এমিলি রায় ইশার থাকার কথা ছিল হাসপাতালে। হাতে চিকিৎসাপত্র, ঔষুধ অথবা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। রোগীকে সেবা দেওয়ায় ব্যস্ত থাকতেই পারতেন ইশা। কিন্তু পেশায় নার্স হয়েও ইশা হাতে তুলে নিয়েছেন তরবারি। শুধু তাই নয়, শনিবার শেষ হওয়া জুলাই রেভুলেশন ফেন্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে পদক মঞ্চেও উঠেছেন মিরপুরের তরুণী। মিরপুর ফেন্সিং ক্লাবের হয়ে এতদিন খেললেও এবার আনসারের জার্সিতে মেয়েদের ফয়েল এককে জিতেছেন ব্রোঞ্জ।
শুরুতে ফেন্সিং কেমন খেলা সেটা জানতেনই না ইশা। ২০২১ সালে পড়তেন মিরপুর বাংলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে। সেবার ফেডারেশন থেকে দুজন কোচ জুনিয়র ফেন্সার খুঁজতে গিয়েছিলেন বাংলা কলেজে। তরবারি দিয়ে মারামারির খেলার ডেমোনেস্ট্রেশন দেখে খেলাটিকে ভালোবেসে ফেলেন ইশা। এরপর ২০২২ সালে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই জুনিয়র বিভাগে জেতেন সোনা।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ইশার। মিরপুর ক্রীড়া পল্লীতে চলছে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের ক্যাম্প। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলের ক্যাম্পেও একমাত্র জুনিয়র হিসেবে ডাক পেয়েছেন তিনি।
এবারের জুলাই রেভুলেশন চ্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়র ও অভিজ্ঞদের জয় জয়কার। তারপরও তিনি অন্তত সোনা জিততে চেয়েছিলেন। ব্রোঞ্জ জিতে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ ইশার, “আমি নিজের খেলায় সন্তুষ্ট না। কারণ যেভাবে প্র্যাকটিসে খেলি সেভাবে খেলতে পারিনি। আরও ভালো করতে পারতাম। কিন্তু এখানে অনেক নার্ভাস হয়ে পড়ি। সিনিয়রদের হারাতে পারব কি পারব না এই ভয় পেয়ে বসেছিল।”
ইশার বাবা রিচার্ড রায় মেডিকেল টেকনোজিস্ট। শুরুতে মেয়েকে ফেন্সিংয়ে আসতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু যতোই দিন গড়িয়েছে মেয়েকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। ইশা বলেন, “প্রথম দিকে বাবা সমর্থন দিতেন না। কারণ এটা ব্যয়বহুল খেলা। যে ব্লেড দিয়ে খেলি এটা প্রায়ই ভেঙে যায়। ইকুয়েপমেন্ট কিনে দিতেন না বাবা। বলতেন, এটা খেলে কি হবে? যদিও এখনও তত ফেমাস না খেলাটা। প্রথম দিকে সমর্থন দিত না। কিন্তু যখন দেখলেন যে আমি নিয়মিত ভালো করছি তখন সাহস যোগাতেন। উৎসাহ দিতেন। আমি খারাপ খেললে কষ্ট পান বাবা।”
মারামারির খেলা হলেও কখনও ইনজুরিতে পড়েননি ইশা। তিনি বলেন, “খেলার সময় সেভাবে ইনজুরিতে পড়িনি। এই খেলায় এত বড় আঘাত কখনও লাগে না। অনেক নিরাপদ খেলা। সেফটি মেনটেইন করে খেলি। ছোটখাটো আঘাত লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যায় “
২০২২ সালে প্রথমবার জুনিয়রে সোনা জেতার ঘটনাটা এখনও মনে পড়ে, “ওই দিন সোনা জয়ের পর বাবা আনন্দে কান্না করে দিয়েছিলেন। আত্মীয় স্বজনদের সবাইকে ফোন দিয়ে বলেন দেখো আমার মেয়ে ন্যাশনালে সোনা জিতেছে।”
এত খেলা থাকতে কেন ফেন্সিং বেছে নিলেন? এমন প্রশ্নে বলেন, “আসলে যখন প্রথম আসি তখন কিছু বুঝতাম না। ফেন্সিং নাম তখন প্রথম শুনি। জাহিদ স্যার ও ফারুক স্যার ডেমোনেস্ট্রেশন দেখালেন কলেজে। এরপর খেলতে খেলতে ভালো লেগে যায়। এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং খেলা। যখন ভালো করতে শুরু করি তখন ভালো করার পিপাসা আরও বেড়ে যায়।”
২০২২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর নার্সিংয়ের কোর্সে ভর্তি হন ইশা। মিরপুরের সাইক নার্সিং কলেজের ছাত্রী বলেন, “ এখানে প্রচুর কষ্ট করা লাগে। কলেজে ৮০ ভাগ উপস্থিত থাকা লাগে। যদিও পড়াশুনায় আমি ভালো। সিজিপিও ভালো। খেলা ও পড়া দুটোই সমানভাবে মেইনটেন করি। তাছাড়া আমার ক্লাসমেটরাও অনেক হেলপফুল। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।”
তিনি বলেন, “ আমাদের দেখে কখনও কোনও মেডিকেল স্টুডেন্ট খেলাধুলা করছে ও পড়াশুনা করছে এটা বিরল। আমি খেলতে পেরে গর্বিত। আমার কোচ মনির স্যারও আমাকে নিয়ে গর্বিত।”
এসএ গেমসের ক্যাম্পে ডাক পাওয়ায় যদিও কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছেন ইশা,“স্যারদের কাছে অ্যাপ্লিকেশন করি। বলেছি আমি ক্যাম্প করতে চাই। এবং পড়তেও চাই। প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন তুমি ছুটিতে থাকো। তবে মিডটার্ম দিয়েছি ২৬ আগস্ট। আমি নার্সিং ও খেলা দুটোই উপভোগ করছি।”
এরপর তিনি বলেন, “ফেন্সিং আমার ভালোবাসা। তবে শুধু বাবা মায়ে জন্য পড়াশুনা করছি।”
ইশা জানেন, ফেন্সিংয়ে নয় শেষ পর্যন্ত নার্সিংয়েই ক্যারিয়ার গড়তে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফেন্সিং নিয়ে বেশি দূর যাওয়ার সুযোগ নেই। তবু বলে যান, “ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নার্সিংকেই বেছে নিতে হবে। এখানে ফেন্সিংয়ে ভালো কিছু করলেও কতটাই বা সুযোগ পাবো?”
তারপরও ইশা স্বপ্ন দেখেন এসএ গেমসে তার গলায় উঠবে সোনার পদক। বাজবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’