বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করেই চলেছে পাশের দেশ ভারত।
মাস পাঁচেক আগে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল দেশটি। আড়াই মাস আগে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
সবশেষ মাস খানেক আগে ১১ আগস্ট স্থলপথে পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের কাপড়, পাটের দড়ি বা রশি, পাটজাতীয় পণ্য দিয়ে তৈরি দড়ি বা রশি এবং পাটের বস্তা বা ব্যাগ আমদানিতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
এর ফলে এখন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া আর কোনও পণ্য স্থলপথে ভারতে রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ।
এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, প্রতিবেশী দেশটির বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক কমে যাবে। কারণ, সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগে।
কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এতো বাধার পরও ভারতে রপ্তানি কমেনি; উল্টো বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রবিবার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ভারতের বাজারে ৩১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, এই অঙ্ক গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক শূন্য চার শতাংশ বেশি।
অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ভারতে ১৪ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত বছরের জুলাইয়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে ১৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার রপ্তানি হয়েছে, বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছরের আগস্টে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এই দুই মাসে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৮ কোটি ৮১ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) জুলাই-আগস্টের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র দশমিক ৮৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারত ছিল বাংলাদেশের অষ্টম বড় রপ্তানি বাজার।এই আর্থিক বছরে ভারতে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা ছিল আগের অর্থ বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।
গত অর্থ বছরে ভারত থেকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ আসে।ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের বড় বাজারগুলো হলো— যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও পোল্যান্ড।
ভারতের বাজারসহ বিভিন্ন দেশে পোশাক রপ্তানি করে এম বি নিট ফ্যাশন লিমিটেড।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা ভালো অবস্থায় আছি। ট্রাম্প শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে আসায় আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনামের চেয়েও ভালো অবস্থায় আছি আমরা। ইতোমধ্যে চীনের অনেক অর্ডার বাংলাদেশে আসছে।”
সামগ্রিকভাবে ভারতে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন বিকেএমইএ সভাপতি।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “আমাদের পোশাকপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বেশি।আর সমুদ্রপথে পোশাক নেওয়ার খরচ দেয় ভারতীয় ক্রেতারা। স্থলবন্দরের বিধিনিষেধে পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
“কেননা, সমুদ্রপথে পোশাক রপ্তানিতে সময় একটু বেশি লাগলেও পরিবহন খরচ কম পড়ে। আগেও বেশিরভাগ পোশাক সমুদ্রপথেই রপ্তানি হতো। ভারতে মোট রপ্তানির অর্ধেকই আসে পোশাক থেকে। এখন যে রপ্তানি বাড়ছে, সেটা মূলত পোশাক রপ্তানি বাড়ার কারণেই বাড়ছে।”
অনুকুল পরিস্থিতির কারণে আগামী দিনগুলোতেও পোশাক রপ্তানি বাড়ার আশায় আছেন তিনি। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “স্থলপথে নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতে অন্যান্য পণ্য রপ্তানি কমলেও পোশাক রপ্তানি বাড়বে।”
ভারতের বিধিনিষেধ
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে গত পাঁচ মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত। গত ১৭ মে ও ২৭ জুন দুই দফায় পোশাক, খাদ্যপণ্য, পাটপণ্য, তুলা-সুতার বর্জ্য, প্লাস্টিকের পণ্য ও কাঠের আসবাব রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেওয়া হয়।
তৃতীয় দফায় ১১ আগস্ট আরও কিছুসংখ্যক পাটপণ্যে বিধিনিষেধ দেয় দেশটি।
এসব বিধিনিষেধ অনুযায়ী, পাট ও পোশাক পণ্য বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি করা যাবে না।শুধু দেশটির মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতে হবে।
এর বাইরে খাদ্যপণ্য ও কোমল পানীয়, কাঠের আসবাব, তুলা-সুতার বর্জ্য, প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রে বুড়িমারী ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ছাড়া শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত স্থলবন্দরগুলো দিয়ে রপ্তানি করা যাবে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের স্থলবন্দর দিয়ে ওই পণ্যগুলো রপ্তানি করা যাবে না।
ভারতে বাংলাদেশ থেকে যা রপ্তানি আয় হয়, তার ৪৫ শতাংশের মতো আসে পোশাক খাত থেকে।
বিধিনিষেধের আগে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে ভারতে রপ্তানি হতো ৩০ শতাংশ পোশাক।স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হতো ৬৯ শতাংশ। প্রায় ১ শতাংশের কাছাকাছি যেত আকাশপথে।
বিধিনিষেধের পর এখন প্রায় সব পোশাকই যাচ্ছে সমুদ্রপথে।
ভারতে বাংলাদেশি পোশাকের বেশির ভাগ কিনেছে এইচঅ্যান্ডএম, এমঅ্যান্ডএস, পুমা, ইউনিক্লো, ডিক্যাথেলন, পেপে জিন্স, ম্যাঙ্গে ফ্যাশন, বেস্টসেলারের মতো অন্তত ১৫টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আগের চেয়ে বেশি পোশাক কিনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তাদের আউটলেটগুলো থেকে বিক্রি করছে।”
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতের বাজারে ১৫ কোটি ২১ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে প্রথম মাস জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছে ৬ কোটি ২৮ লাখ ডলারের পোশাক। আগস্টে রপ্তানির অঙ্ক ৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার।
জুলাই-আগস্ট সময়ে প্লাস্টিক দ্রব্য, কাঠের আসবাব ও তুলার বর্জ্য রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ডলারের বেশি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি।
এই দুই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
তবে পাটপণ্য রপ্তানিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভারতে বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানি হতো মূলত স্থলবন্দর দিয়ে। দু-একটি চালান যেত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন পাটপণ্য শুধু সমুদ্রপথে ভারতের মুম্বাইয়ের নভোসেবা বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতে হচ্ছে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, বিধিনিষেধের আগে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছিল ২ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের।
বিধিনিষেধের পর ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তা ৭০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।
খাদ্যপণ্য এখন শুধু ভোমরা ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানির সুযোগ রেখেছে ভারত। সমুদ্রপথেও রপ্তানি করা যাবে। বাকি সব স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বিধিনিষেধের আগে গত বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৮০ লাখ ডলারের বিস্কুট ও পানীয় রপ্তানি হয়েছিল। চলতি বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৬৮ লাখ ডলার।
ভারতে খাদ্যপণ্যের বড় রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। গ্রুপটি গত বছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তুলনায় এবার ভারতে ১৫ শতাংশ কম রপ্তানি করেছে।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ঘুরপথে পণ্য পাঠাতে ৮ থেকে ৯ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এটা সমাধান করা উচিত।”
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ প্রথম আরোপ করে ভারত।
গত ৮ এপ্রিল বাতিল করা হয় বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা, যার আওতায় ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির সুবিধা পেত বাংলাদেশ। ১৫ এপ্রিল ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ।
এরপর স্থলপথে পণ্য রপ্তানিতে একের পর বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে ভারত।