বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমছে; বিষয়টি আশীর্বাদ বয়ে এনেছে বাংলাদেশের জন্য। আর এই সুখবর নিয়ে আসছে মূলত বহুল আলোচিত ট্রাম্প শুল্ক।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৬৯২ কোটি ৩২ লাখ (৬.৯৩ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তনি করেছে চীন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক শূন্য এক শতাংশ কম।
গত বছরের একই সময়ে এই বাজারে চীনের রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৮৭৬ কোটি ৪২ লাখ (৮.৭৬ বিলিয়ন) ডলার।
এই সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। জানুয়ারি-জুলাই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯৮ কোটি ২১ লাখ (প্রায় ৫ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৪০৯ কোটি ৪৯ লাখ (৪.০৯ বিলিয়ন) ডলার।
সবশেষ জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমেছে ৩৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এই মাসে ১১৯ কোটি ৫৩ লাখ (১.১৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন; ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৯৩ কোটি ৯২ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলার।
বিপরীতে জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই মাসে ৭২ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ; ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৬৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
তার আগের মাস জুনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। চীনের কমেছে ৪০ শতাংশ।
এই ধারা আগামী দিনগুলাতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, বেশি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পোশাক রপ্তানি কমতেই থাকবে। আর কম শুল্কের কারণে এর সুফল পাবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা এতদিন যেসব পোশাক চীন থেকে কিনতেন, তারা এখন বাংলাদেশ থেকে কিনবেন। ইতোমধ্যেই চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অনেক অর্ডার বাংলাদেশে এসেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
শুধু ট্রাম্প শুল্কের কারণে নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলা দু-দেশের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ক্রমে অবস্থান হারাচ্ছে প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীন। দেশটির হারানো অবস্থানে হিস্যা বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। মোট রপ্তানি আয়, রপ্তানির পরিমাণ ও পণ্যমূল্য- সব বিবেচনায় চীনের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে বাংলাদেশ।
মার্কিন পাল্টা শুল্ক কাঠামোতে চীন এবং অন্য রপ্তানিকারক প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ফলে আগামীতে চীনা হিস্যা বেশ ভালোভাবেই বাংলাদেশ বুঝে নেবে বলে আশা করছেন রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা।
মার্কিন নতুন শুল্ক কাঠামোয় চীনা পণ্যের শুল্ক ১৪৫ শতাংশের মতো। অবশ্য প্রকৃত শুল্ক কত, তা এখনও কোনও পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি। বাংলাদেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ। আবার মার্কিন কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধার মতো বড় শুল্কছাড়ও পাচ্ছে বাংলাদেশ।
একক দিশ হিসাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। মোট পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশের মতো আসে দেশটি থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) ২০১৫ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত এক দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি মূল্যের বিবেচনায় চীনা তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে ৪৬ শতাংশ। এ সময় বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৫৪ কোটি (৩০.৫৪ বিলিয়ন) ডলার। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে তা নেমে আসে এক হাজার ৬৫১ কোটি (১৬.৫১ বিলিয়ন) ডলারে।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৪০ কোটি (৫.৪০ বিলিয়ন) ডলার, গত বছর তা বেড়ে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারে উন্নীত হয়েছে।
হিসাব বলছে, এই ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৪৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। বিপরীতে বাংলাদেশের বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্টের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে চীন ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ২০১৭ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন, সে সময় থেকেই চীন-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক লড়াই শুরু হয়। তখন থেকেই চীনা পোশাকের রপ্তানি কমতে থাকে।
“আগামীতে আরও কমবে। সেখানে বাংলাদেশ আরও ভালো করবে। তবে আমাদের মূল্য সংযোজিত পণ্যে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এখন ভলিউমে বেশি রপ্তানি করেও কম মূল্য পাই আমরা। ভিয়েতনাম কিংবা অন্যান্য দেশ কম রপ্তানি করেও বেশি মূল্য পায়। এখন ভলিউমে যে পরিমাণ রপ্তানি করি, তাতে যদি মূল্য সংযোজন করা যেত, তাহলে একই পরিমাণ রপ্তানি থেকে বড় অঙ্কের রপ্তানি আয় সম্ভব হতো।”
পরিমাণে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পোশাকের রপ্তানি কমেছে ১৮ শতাংশেরও বেশি, যেখানে বাংলাদেশের বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। ২০১৫ সালে চীনা পোশাক রপ্তানি হয়েছিল এক হাজার ১৩৮ মিটার। গত বছর তা ৯২৯ মিটারে নেমে আসে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১৮৭ মিটার, যা গত বছর ২৩৭ মিটারে উন্নীত হয়।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যপ্রতি দর বা ইউনিট প্রাইসও কমেছে ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো।
উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দশকের শুরুতে ২০১৫ সালে চীনা পণ্যের গড় ইউনিট প্রাইস ছিল দুই ডলার ৬৮ সেন্ট। ২০২৪ সালে তা কমে এক ডলার ৭৮ সেন্টে নেমে আসে। যেখানে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের পোশাকের ইউনিটপ্রতি গড় দর ছিল দুই ডলার ৮৯ সেন্ট। তা থেকে বেড়ে গত বছর তিন ডলার ১০ সেন্টে উন্নীত হয়।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হয়েছে গত ৮ আগস্ট। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে এখন সব মিলিয়ে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে বলে হিসাব দিয়েছে এ খাতের রপ্তানিকারকদের প্রধান সংগঠন বিজিএমইএ।
তারপরও সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বাংলাদেশ। কেননা, ট্রাম্প শুল্ক কার্যকরের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের হারানো ব্যবসা পাচ্ছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত কয়েক মাস ধরেই চীনের হারানো ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসছে। আগামী দিনগুলোতে আরও বেশি বেশি আসবে বলে আশা করছেন তারা।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ট্রাম্প শুল্ক বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে। কারণ, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। তখন থেকেই চীন থেকে অল্প অল্প করে ক্রয়াদেশ সরছিল।
“গত বছর নির্বাচনী প্রচারণায় চীনের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বাড়তি ক্রয়াদেশ দেওয়া শুরু করে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়তে থাকে।”
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ট্রাম্প চীনের ওপর চূড়ান্ত পাল্টা শুল্ক কতোটা বসাবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদি সেটা বড় অঙ্কের হয়, তাহলে চীন থেকে ক্রয়াদেশ আরও সরবে। দেশটি থেকে বেশি মূল্যের যেসব পোশাক সরবে, তার বড় অংশ পাবে ভিয়েতনাম। তবে স্থানান্তরিত হওয়া কম মূল্যের পোশাকের অধিকাংশ বাংলাদেশে আসবে।”
তিনি বলেন, “পাল্টা শুল্ক নিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরু থেকে নতুন করে চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরছে। তার একটি অংশ বাংলাদেশেও আসছে। পাল্টা শুল্কের কারণে সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তি ক্রয়াদেশ আসতে পারে।
“ট্রাম্প শুল্কহারের বিচারে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কারও কাছ থেকে হুমকিতে পড়তে হচ্ছে না বাংলাদেশকে। সে কারণেই আমার মনে হচ্ছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছি আমরা।”
বাংলাদেশি পণ্যে ট্রাম্প শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার পর গত ২ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে এখন সব মিলিয়ে আমাদের ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।”
হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, “আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এমএফএন (মোস্ট ফেডারড নেশন) শুল্ক দিতাম। এখন যে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে, এর ফলে আমাদের মোট শুল্কের হার দাঁড়াল ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন হারে প্রযোজ্য হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মার্কিন রপ্তানির প্রায় ৭৫ শতাংশ হচ্ছে তুলাভিত্তিক পোশাক। শুল্কসংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে বলা আছে, যদি ন্যূনতম ২০ শতাংশ আমেরিকার কাঁচামাল (যেমন তুলা) ব্যবহার করা হয়, তাহলে আমেরিকার কাঁচামালের মূল্যের ওপর এই অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ আমেরিকার কাঁচামাল ব্যবহার করলে আমরা বাড়তি কিছু শুল্ক ছাড় পাব।”