Beta
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভূমিকম্পের পর আফগানিস্তানের কী হাল

Afghan
[publishpress_authors_box]

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে।

রবিবার স্থানীয় সময় রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এর কেন্দ্র ছিল জালালাবাদ শহরের (দেশটির পঞ্চম বৃহত্তম নগরী) উত্তর-পূর্বে নাঙ্গারহার প্রদেশে, শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে।

ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল মাত্র ৮ কিলোমিটার। রাজধানী কাবুলসহ ১৪০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত তা অনুভূত হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানেও কম্পন টের পাওয়া যায়। প্রাথমিক হিসেবে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রধান কম্পনের পর একাধিক শক্তিশালী আফটারশক বা পরাঘাত আঘাত হানে। এতে আরও অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যা জানা গেছে এখন পর্যন্ত

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের নানগারহার ও কুনার প্রদেশের পশ্চিমাংশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় উদ্ধারকাজ অত্যন্ত জটিল। তালেবান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৮০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। তবে চূড়ান্ত সংখ্যা এখনও নিশ্চিত নয়। আরও শত শত মানুষ আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বিবিসিকে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রস্থলের দিকে যাওয়া মূল সড়কটি ভূমিধসে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই তালেবান প্রশাসন হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আহতদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

সরকারি একাধিক সূত্র বলছে, বহু বাড়িঘর ধসে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে এবং কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের কর্মকর্তা সালাম আল জানাবি জানিয়েছেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর সড়ক এখনও বন্ধ। ধারণা করা হচ্ছে শত শত ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন জানিয়েছে, কুনার প্রদেশের চাওকি ও নুরগাল অঞ্চলের পুরো গ্রাম আংশিক বা পুরোপুরি ধসে পড়েছে। কাদামাটি ও কাঠের তৈরি ঘরগুলো ভেঙে পড়ে বাসিন্দারা ভেতরে চাপা পড়েছেন।

অনেক মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্বংসস্তূপে আটকে থেকে উদ্ধারকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা গেছেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নুরগালের এক স্থানীয় কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোর বহু বাসিন্দা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান ও পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিলেন। এই দুটি দেশই সম্প্রতি এক মিলিয়নেরও বেশি আফগানকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ জোরদার করেছে।

ভূমিকম্পের কয়েক দিন আগেই আকস্মিক বন্যায় অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। বন্যায় সৃষ্ট ভূমিধস ও অবকাঠামোর ক্ষতির কারণে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মধ্যে যান চলাচলও সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।

খবর পৌঁছাতে সময় লাগছে কেন

দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন। যোগাযোগব্যবস্থা সীমিত হওয়ায় তথ্য আসতেও সময় লাগছে। অবকাঠামোর ক্ষতি পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।

পূর্ববর্তী বড় ভূমিকম্পগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দুর্গত এলাকায় পৌঁছানোর পরই মৃতের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছানোয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বাধা সৃষ্টি করছে। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী তাদের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে বিবিসি’র মতো সংস্থাগুলো আফগানিস্তান থেকে তাদের বহু সাংবাদিককে সরিয়ে নেয়। একইভাবে অনেক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও ত্রাণ সংস্থা দেশটিতে কাজ স্থগিত করেছে। ফলে মাঠপর্যায়ের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

তবে আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণে আনুষ্ঠানিক কোনও বাধা নেই দেশটিতে।

আফগানিস্তান কি পরিস্থিতি সামলাতে পারবে

তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তান কার্যত অর্থনৈতিক পতনের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটির হিসাবে, বর্তমানে দুই কোটিরও বেশি আফগান মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

বিদেশি অনুদান প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। ১৯৯০-এর দশকে তালেবান শাসনকালে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল আছে, যদিও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে।

তালেবান শাসনের আগে আফগানিস্তানের মোট বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশই আসত বিদেশি অনুদান থেকে। এতে স্বাস্থ্যসেবার প্রায় সব খরচ মেটানো হতো। সেই ব্যবস্থার পতনে এখন স্বাস্থ্যখাত ভেঙে পড়েছে।

ভূমিকম্পকেন্দ্রের কাছাকাছি জালালাবাদের প্রধান হাসপাতাল এখন চরম চাপে। এটি আশপাশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্র। একই জায়গায় প্রতিবেশী পাকিস্তান থেকে জোর করে ফেরত পাঠানো হাজার হাজার আফগানও প্রবেশ করছে।

বিদেশে থাকা আফগানিস্তানের আর্থিক সম্পদও (মূলত যুক্তরাষ্ট্রে) জব্দ রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইডের সহায়তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো পুনর্গঠনে বহু বছর লেগে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যেই পশ্চিম হেরাত প্রদেশের বহু গ্রাম এখনও ঠিক হয়ে ওঠেনি। সেখানে প্রায় দুই বছর আগে শক্তিশালী একাধিক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল।

কেন নারীরা ও মেয়েরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে

তালেবান সরকারের আরোপিত নানা বিধিনিষেধের কারণে আফগানিস্তানে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে নারীদের ও মেয়েদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা কেয়ার এর আফগানিস্তান শাখার প্রধান গ্রাহাম ডেভিসন বলেন, এই বিধিনিষেধের ফলে নারীদের জীবনরক্ষাকারী সেবায় প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ভূমিকম্পের পর নারীরা ও মেয়েরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন।

কুনার একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল এলাকা। সাংস্কৃতিক কারণে সেখানে নারীরা চিকিৎসা দেরিতে পান। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু নারী হয়তো হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পরিবারের অপেক্ষা করেছে। অথবা রাতের বেলা নয়, দিনের আলো ফোটার পর চিকিৎসার জন্য গেছেন।

২০২২ সালে পাকতিকা প্রদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেখা গিয়েছিল, আহত নারীদের হাসপাতালে ভিড় দুই দিন পর থেকে বাড়তে শুরু করে। আরও একটি গুরুতর বিষয় হলো, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কোনও নারী উদ্ধারকর্মী নেই।

কেন আফগানিস্তানে ভূমিকম্প এত ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনে

আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। কারণ এটি এমন অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়।

২০২২ সালে পাকতিকা ও ২০২৩ সালে হেরাত প্রদেশে আঘাত হানা ভূমিকম্পে দুই হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ গঠিত টেকটোনিক প্লেটের আকস্মিক সরে যাওয়া বা নড়াচড়া থেকে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। প্লেটের সংঘর্ষস্থলে যে ভাঙন তৈরি হয় তাকে ফল্ট লাইন বলা হয়।

আফগানিস্তানে অগভীর ভূমিকম্প বেশি ঘটে থাকে। এসব ভূমিকম্প আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হয় কারণ কম্পন তরঙ্গের পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় না। ফলে শক্তি অবিকৃতভাবে পৃষ্ঠে এসে আঘাত হানে।

এছাড়া দেশটির অধিকাংশ ভবন কাঠ, কাদামাটির ইট বা নিম্নমানের কংক্রিট দিয়ে তৈরি, যেগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়।

ভূমিকম্পের আরেকটি বড় বিপদ হলো ভূমিধস। এতে পাহাড়ি গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে যায় এবং নদী-নালা আটকে গিয়ে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত