দুই যুগ আগে আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন যে রাষ্ট্রনেতার কাছ থেকে, তিনি হলেন টনি ব্লেয়ার।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ব্লেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে যে নোট চালাচালি তখন করেছিলেন, তা বিবিসি পরে প্রকাশ করে।
সেখানে দেখা যায়, ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে অভিযানের জন্য বুশকে প্ররোচিত করেছিলেন ব্লেয়ার।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা শুরু করলে যুক্তরাজ্যও তাতে যোগ দেয়। এই হামলার যৌক্তিকতা প্রমাণে টনি ব্লেয়ার ছিলেন সরব।
তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনায় পড়লেও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের নেক নজরেই ছিলেন ব্লেয়ার। জর্জ বুশ ২০০৯ সালে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ব্লেয়ারকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ এ ভূষিত করে যান।
তার দুই বছর আগেই ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষ করেন ব্লেয়ার। লেবার পার্টিতে ইহুদি লবির ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ব্লেয়ার পরে মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ দূত হিসাবেও কাজ করেন।
৭২ বছর বয়সে এসে নতুন দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন তিনি। বুশের দল রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে ২০ দফা পরিকল্পনা হাজির করেছেন, তা বাস্তবায়নে নিজের সঙ্গী হিসাবে রাখছেন ব্লেয়ারকে।
দুই বছর ধরে ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি জনপদ গাজায় যুদ্ধ বন্ধে সোমবার হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি অর্জনের ‘খুব কাছাকাছি’ আছেন তারা।
এই পরিকল্পনায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধ, গাজায় জিম্মিদের মুক্ত, হামাসকে নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজা শাসনে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প, যে কর্তৃপক্ষ হবে ফিলিস্তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে।
তবে ওই কর্তৃপক্ষ নির্বাচনসহ গাজা দেখভালের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প, যার নাম হবে ‘বোর্ড অব পিস’।
এই সংস্থার নেতৃত্বে নিজেকেই রাখার কথা জানিয়ে ট্রাম্প সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এর নেতৃত্বে থাকবেন একজন ভদ্রলোক, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প নামে পরিচিত।”
এই সংস্থায় তার সঙ্গে আর যারা থাকবেন, তাদের একজনের নাম ট্রাম্প প্রকাশ করেছেন, তিনি হলেন টনি ব্লেয়ার।
ট্রাম্প বলেছেন, “একজন হলেন যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তিনি একজন ভালো মানুষ, খুব ভালো মানুষ।”
ট্রাম্প মূলত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এই ‘বোর্ড অব পিস’ গঠন করতে চাইছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত সংস্কার সম্পন্ন করার পর গাজার ক্ষমতাভার নিতে প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত এই সংস্থাই গাজার পুনর্গঠনের জন্য কাঠামো তৈরি করবে এবং অর্থের জোগান দেবে।
যদি ট্রাম্পের পরিকল্পনাটি এগিয়ে যায়, তবে টনি ব্লেয়ার গাজা পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক দলের একজন সদস্য হবেন। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের জন্য সমালোচনায় পড়লেও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের কয়েক দশকের সংঘাত অবসানের জন্য প্রশংসিতও তিনি।
ব্লেয়ারের সম্ভাব্য এই নিয়োগকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে জাতিসংঘ দূত, ব্যক্তিগত উপদেষ্টা এবং একজন ‘ছায়া মধ্যস্থতাকারী’ হিসাবে দীর্ঘদিন তার সম্পৃক্ততার মূল্যায়ন হিসাবে দেখা হচ্ছে।
১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট নিয়ে সরাসরি তাকে কাজ করতে হয়েছে।
এরপর পশ্চিমা দেশগুলোর হয়ে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ দূত হিসাবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। পরে তিনি টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করে।
এক সময় বুশের ছায়ায় থাকা ব্লেয়ার এখন ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রণয়নেও নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রেখেছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট দাবি করেছে।
পত্রিকাটি লিখেছে, ব্লেয়ারের এই সম্পৃক্ততা ফিলিস্তিনি অনেককে হতাশ করেছে, যারা ইরাক যুদ্ধে তার ভূমিকা এবং ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থনের কথা মনে রেখেছে।
ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের মহাসচিব মোস্তফা বারঘুতি বলেছেন, “এখানে ব্লেয়ারের একটি নেতিবাচক খ্যাতি রয়েছে। তার নাম নিলেই মানুষের মনে প্রথমে ইরাক যুদ্ধের কথা আসে।”
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের উপদেষ্টা মাহমুদ হাব্বাশ কোনও মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজনই দেখছেন না। তিনি বলেন, “গাজা শাসন করার জন্য আমাদের কেবল একটি ফিলিস্তিনি সরকার দরকার, এর বেশি কিছু নয়।”
তবে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষিত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে ব্লেয়ারের সম্পৃক্ততা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজা শাসন করবে- এই ধারণা ইসরায়েল সহজে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু ব্লেয়ারের মতো কেউ মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকলে তা হয়তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কারণ ইসরায়েল তাকে শ্রদ্ধা করে।”
ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ব্লেয়ারের উষ্ণ সম্পর্কের কথাই জানা যায়।
ব্লেয়ারের জীবনীকার জন রেন্টউল এক্ষেতে মত দিয়েছেন, “তার ব্যক্তিত্বের একটি শক্তিশালী দিক আছে। তার এক ধরনের গভীর আত্মবিশ্বাস রয়েছে যে তিনি বিশ্বের কঠিনতম সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন।
“ব্লেয়ার যে কারও সাথে কথা বলবেন। তার একটি শক্তির দিক হলো, তিনি কারও সঙ্গে কাজ করতে বিচলিত হন না।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, ওয়াইনেট