ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিক একটি হিসাব দিয়েছেন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
সোমবার সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, শনিবার কার্গো ভিলেজের ভয়াবহ আগুনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকা।
উদ্বেগ প্রকাশ করে হাতেম বলেন, “কার্গো ভিলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন শনাক্ত ও প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে দেশের আমদানি-রপ্তানি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের ব্যবসায়ী সমাজ ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা শঙ্কিত এবং আমাদের বৈদেশিক ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন।
“এই ধরনের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর নয় এবং এটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”
হাতেম বলেন, “অনেক বছর ধরে আমরা রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করে আসছি যে, আমাদের পণ্য ও মালামাল খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়, সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই এবং প্রায়ই আমদানিকৃত মালামাল চুরি হয়। এটি শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ নয় বরং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে।”
দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন খাতের সংগঠনগুলোর এপেক্স বডি এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। এই সংগঠের সঙ্গে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিজিএপিএমইএ, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস, ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবলস, ঔষধ শিল্প, জুয়েলারি এক্সপোর্টার্স, সুইং থ্রেড, ফ্রোজেন ফুড, প্লাস্টিক গুডস, সিল্ক গুডস, হস্তশিল্প, ক্রাফ্ট অ্যান্ড গিফ্ট ওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনসহ অন্যান্য সংগঠন সম্পৃক্ত।
মোহাম্মদ হাতেম নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএরও সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে শুধু ব্যবসায়ী নয়, সরকারও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট হয়েছে এবং বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
“আমরা চাই, এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর সরকার ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করে দ্রুত পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। শাহজালাল বিমানবন্দর দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের হৃৎপিণ্ড- এখানে এমন অঘটন আমরা আর দেখতে চাই না।”
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এই ঘটনায় শুধু আর্থিক ক্ষতিই হয়নি; দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে একাধিক আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ঢাকায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও উদ্বেগজনক।”
“এখন জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- এই অগ্নিকাণ্ড কি কেবলই একটি দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রয়েছে?” প্রশ্ন করেন তিনি।
হাতেম বলেন, “আমরা আমাদের সদস্যদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছি, তবে এখনও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়নি। একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে সামগ্রিক ক্ষতির সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে। তবুও প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা- সব মিলিয়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, বিদেশি ক্রেতারা এই অগ্নিকাণ্ডের খবরে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হতে পারেন, যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই ঝুঁকি নিরসনে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।”
“এই প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, সরকার ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিশন গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন,” বলেন ইএবি সভাপতি।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ বলেন, “পাঁচ দিনের মধ্যে দেশে বড় ধরনের তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা ‘ষড়যন্ত্র’ দেখতে পাচ্ছি। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ এমন একটা জায়গায় পড়েছে, যেখানে অনেকের চোখ পড়েছে; এক ধরনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে।
“বহির্বিশ্বে যেন আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, তা নিয়ে এক ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। পার্শ্ববর্তী দেশের এক ধরনের চিন্তাভাবনা আছে, যেন তাদের ব্যবসাটা ভালো হয়, আমাদের ব্যবসা কমে যায়।”
শওকত আজিজ বলেন, “আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি। এটা কোনও খেলার মাঠ না, এটা আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর এবং সেটার অবস্থান রাজধানীতে। আমাদের ভাববার বিষয় আছে; ভীষণভাবে ভাববার বিষয় আছে। অনেক ক্রেতা আমাদের দেশ থেকে চলে যাচ্ছেন। অনেক ক্রেতা, যাদের আসার কথা ছিল, তারা আসবেন কিনা, চিন্তা করছেন।”
ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ঢাকার মিরপুরে রূপনগর এলাকায়। গত মঙ্গলবার সেখানে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে প্রায় ২৮ ঘণ্টা পরে।
এরপর বৃহস্পতিবার আগুন লাগে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল- সিইপিজেড এলাকার একটি কারখানায়। সেখানে কেউ হতাহত না হলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর।
সবশেষ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে আগুন লাগে, যা ৭ ঘণ্টা পর রাত সোয়া ৯টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর উড়োজাহাজ ওঠানামাও শুরু হয় দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে। কার্গো ভিলেজের আগুন আগুন ২৭ ঘণ্টা পর পুরোপুরি নিভেছে বলে রবিবার বিকালে জানায় ফায়ার সার্ভিস।
এক দিন পর পর এ ধরনের বড় তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নানা মহলে নানা সমালোচনা চলছে। এসব ঘটনা ‘পরিকল্পিত’ কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে।
এসব অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে শওকত আজিজ বলেন, “আমাদের এমনভাবে ক্ষতিটা নিয়ে যাচ্ছে, যেতে যেতে বিমানবন্দর পর্যন্ত চলে গেছে। এরপর আমাদের ঘরবাড়ি পোড়ানোর সময় আসবে।”
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “এক ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমাদের দেশে। একের পর এক কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
“একটা ম্যাচের দাম এক টাকা হতে পারে। কিন্তু একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। একটা গ্রুপ আছে, যারা জিনিসগুলো মূল্যায়ন করে না।”
‘২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়েছে’
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, কার্গো ভিলেজের আগুনে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ওষুধের কাঁচামাল পুড়ে গেছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ৩০৭টি ওষুধ কোম্পানি আছে। এর মধ্যে ২৫০ কোম্পানি সচল আছে। আজকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় ৩২ কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের ২০০ কোটি টাকার বেশি কাঁচামাল পুড়ে গেছে। বাকি কোম্পানিগুলো হিসাব দিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।”
জাকির হোসেন বলেন, একেকটি ওষুধ উৎপাদনে ১০-১২টি থেকে ৫৩টি উপকরণের প্রয়োজন হয়। ফলে ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ার কারণে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার ওষুধের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
তবে এখনই সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হবে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব।
জাকির হোসেন বলেন, শনিবার আগুনের সময় অনেক বিমান চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেসব বিমানে থাকা ওষুধের কাঁচামাল শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে। কেননা ওষুধের কাঁচামাল সংরক্ষণে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি বিষয়। সেখানে এই ব্যবস্থা নেই।
৬ দাবি
সংবাদ সম্মেলনে আগুনের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও ক্ষতি নিরূপণ শেষে দ্রুত ছয়টি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে দাবি জানান ইএবি সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। এগুলো হলো-
>> অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের বিপরীতে করা বীমা দাবি দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া।
>> যেসব পণ্যের বীমা করা ছিল না, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি বিশেষ তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা দেওয়া।
>> ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কার্গো ভিলেজের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ।
>> ঔষধ শিল্পের জন্য আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলাদা গুদামের ব্যবস্থা করা।
>> নিরাপদ দূরত্বে রাসায়নিক গুদাম স্থাপন।
এবং
>> কার্গো ভিলেজের গুদাম ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা।