ধর্ষণের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে সহিংসতায় তিন পাহাড়ির মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দাঙ্গা বাধিয়ে পার্বত্যাঞ্চলকে অস্থির করার একটি ষড়যন্ত্র চলছে।
রবিবার খাগড়াছড়ির গুইমারায় ব্যাপক সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার পর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে এই দাবি করা হয়।
উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি নাজুক করে তোলার জন্য পাহাড়ি সংগঠন ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে সেনাবাহিনী।
তবে তার প্রতিক্রিয়ায় ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেছেন, সেনাবাহিনী একটি অপরিপক্ব গল্প তৈরি করেছে।
মারমা এক স্কুলছাত্রী গত মঙ্গলবার রাতে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকে উত্তেজনা চলছে খাগড়াছড়িতে।
‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’ ব্যানারে আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত শনিবার খাগড়াছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ চলার সময় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করলেও অবরোধ চলতে থাকে। এরমধ্যে রবিবার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে গুইমারায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়।
ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবার মামলায় শয়ন শীল (২১) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার পরও অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সেনাবাহিনী।
বিবৃতিতে বলা হয়, শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা সত্ত্বেও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপির নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ মিছিল এবং ২৫ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়।
“একই সময় দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ব্লগার এবং পার্বত্য অঞ্চলের কিছু দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ কর্তৃক অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশ করে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়।”
গত ২৬ সেপ্টেম্বর উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং দেশি ও প্রবাসী ব্লগারসহ পার্বত্য জেলার কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির উস্কানিমূলক প্রচারণার প্রভাবে সমগ্র খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বলে সেনাবাহিনীর দাবি।
বিবৃতিতে বলা হয়, অবরোধ চলাকালে এক পর্যায়ে ইউপিডিএফের প্ররোচনায় এলাকাবাসী টহলরত সেনাদলের ওপর ঢিল নিক্ষেপ করে। ফলে তিনজন সেনা সদস্য আহত হন।
এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ পুনরায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা চালায় বলে সেনাবাহিনীর দাবি। বিভিন্ন স্থানে বাঙালিসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ, ভাংচুর, অ্যাম্বুলেন্সে আক্রমণের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকা অস্থিতিশীল করার জন্য এই সংগঠনটিকেই দায়ী করে প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, সেনা-পুলিশের েযৗথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
খাগড়াছড়ি শহরে ব্যর্থ হওয়ার পর ইউপিডিএফ ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাধারণ জনগণকে উস্কে দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে এবং বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বলে সেনাবাহিনীর দাবি।
এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জড়িয়ে পড়ার বিবরণ দিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইট-পাটকেল, গুলতি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনীর ৩ জন অফিসারসহ ১০ জন সদস্য আহত হয়। একই সময় তারা রামগড় এলাকায় বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করে এবং বিজিবি সদস্যদের আহত করে।
“সংঘর্ষ চলাকালীন আনুমানিক ১১.৩০ ঘটিকার দিকে রামসু বাজারের পশ্চিম দিকে অবস্থিত উঁচু পাহাড় থেকে ইউপিডিএফ (মূল) সশস্ত্র দলের সদস্যরা ৪/৫ বার অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে পাহাড়ি, বাঙালি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে আনুমানিক ১০০-১৫০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে, ঘটনাস্থলে সংঘর্ষে লিপ্ত এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর টহল দল দ্রুত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করার লক্ষ্যে উক্ত এলাকায় গমন করে। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় সশস্ত্র দলটি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সমসাময়িক সময়ে রামসু বাজার এবং ঘরবাড়িতে ইউপিডিএফ (মূল) এর বহিরাগত দুষ্কৃতিকারীরা অগ্নিসংযোগ করে এবং বাঙালিদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয়।
রামসু বাজারে অগ্নিসংযোগের জন্য সেনাবাহিনী পাহাড়িদের দায়ী করলেও স্থানীয়রা বাঙালিদেরই দায়ী করছেন।
মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সভাপতি উয়াফ্রে মারমা বিবিসি বাংলাকে বলেন, পাহাড়িদের ওপর হামলা করে উল্টো সেনাসদস্য ও বাঙালিদের ওপর হামলার অভিযোগ তোলা পার্বত্যাঞ্চলের নিয়মিত ঘটনা।
সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে ইউপিডিএফের সাম্প্রতিক নানা তৎপরতার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, গত ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে তিনজন নিহতসহ বেশ কিছু এলাকাবাসী আহত হয়। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর এর ঘটনার এক বছর পূর্তি হিসাবে এই বছর ইউপিডিএফ এবং এর সহযোগী সংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল এর আয়োজন করে এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করে।
সেনাবাহিনী বলছে, “বিগত কয়েকদিনের ঘটনা পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট যে, ইউপিডিএফ এবং তার অঙ্গসংগঠনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে এলাকার মহিলা এবং স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে বাধ্য করছে।
“একই সাথে পার্বত্যাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটনের লক্ষ্যে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিগত ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি এবং গুইমারা এলাকায় বিভিন্ন ঘটনাকে পুঁজি করে আইনের আশ্রয় না নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটনের বিষয়টি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়।”
সেনাবাহিনীর এই বিবৃতিটি নিজের ফেইসবুক পাতায় হুবহু তুলে দিয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সংগঠক মাইকেল চাকমা।
তবে শুরুতেই তিনি লিখেছেন, “এতক্ষণ পর অবশেষে আইএসপিআর ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটা অপরিপক্ক গল্প তৈরি করেছে। গল্পটা যেন সবাই পড়তে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো।”