Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

মাঠ সরকারি, দখলে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব

মাঠ ফিরে পাওয়ার দাবিতে মানববন্ধন স্থানীয়দের।
মাঠ ফিরে পাওয়ার দাবিতে মানববন্ধন স্থানীয়দের।
[publishpress_authors_box]

গুলশান ২ নম্বরের শপিং মল পিংক সিটি। তার উল্টো দিকেই সরকারি একটি মাঠ। নাম শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতি পার্ক, যা আগে ছিল গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক নামে। সরকারি এ মাঠটি এলাকার মানুষের কাছে ছিল নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা, স্বস্তির জায়গা। কয়েক বছর আগেও শিশুরা খেলতো নিয়মিত। সাধারণ মানুষ পার্কে হাঁটতে পারতেন, গল্প করতে পারতেন। কেউ চাইলে নিরিবিলি বসেও থাকতে পারতেন।

“কিন্তু এখন সেসব রূপকথার গল্পের মতো”, বলছিলেন এলাকার বাসিন্দা ফারহানা ইসলাম (ছদ্মনাম)। সরকারি এই চাকরিজীবীর কাছে একসময় পাশের এই মাঠটিই ছিল ‘ভরসা, স্বস্তির’ জায়গা। গৃহকর্মীকে দিয়েও পার্কে ছেলেকে পাঠিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতেন অনেকটা। মাঠেই ছেলের সময় কাটে, বন্ধুও হয় কিছু।

“ছেলের ছেলেবেলা ঘরের ভেতরে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে কাটাতে হয় না- এটা ছিল আমার কাছে এই সময়ে দারুণ এক স্বস্তির। কিন্তু সেই স্বস্তি আর নেই”, আক্ষেপ করে সকাল সন্ধ্যাকে বলছিলেন ফারহানা ইসলাম।

গুলশান ২ নম্বরের পিংক সিটির পেছনের ১৩০ নম্বর প্লটে প্রায় আট একরের এই মাঠ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়।

তখন প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ে মাঠের একদিকে নানা রকম আধুনিক খেলার সরঞ্জাম বসানো হয়। শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতি পার্ক নামে মাঠটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তারপর ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের সঙ্গে মাঠটি নিয়ে তিন বছরের চুক্তি হয় উত্তর সিটি কর্পোরেশনের।

স্থানীয়রা বলছেন, সেই থেকে শুরু মাঠটি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া। মাঠটি নিয়ে উচ্চ আদালতে তিনটি মামলা হয়। আপিল বিভাগ রাজউককে দখল উচ্ছেদের এবং সিটি কর্পোরেশনকে কোনোভাবে লিজ বা দখল দেওয়া বন্ধের নির্দেশনা দেয়।

আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, পার্কটি শুধু পার্ক হিসেবেই থকাবে, কোনও স্থাপনা কোনও অজুহাতেই তৈরি করা যাবে না। এই পার্ক কারও কাছে ইজারা দেওয়ার কোনও অধিকার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ছিল না এবং এখনও নেই।

কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ‘ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলে’ গুলশান ইয়ুথ ক্লাবকে ‘অপারেটর’ হিসেবে নিয়োগ দেয়, যা আসলে ইজারাই।

সম্প্রতি মাঠে গিয়ে ইনডোর ব্যাডমিন্টন কোর্ট, জিমনেশিয়াম, স্কেটিং জোন, লেডিস কর্নার, টেনিস কোর্টসহ নানারকম খেলার সরঞ্জাম দেখতে পাওয়া যায়। তবে সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য নয়। মাঠ চলছে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের নিয়মে। টাকা দিয়ে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবে ভর্তি হয়ে খেলতে হয় সরকারি এই মাঠে।

কিন্তু এই ‘ভর্তি হতে চাওয়ার টাকার অঙ্ক’ ধীরে ধীরে সরকারি চাকরিজীবী ফারহানা ইসলামের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। তা নিয়েই তার আক্ষেপ। শুধু ফারহানা একা নন, এলাকার অনেক বাসিন্দাই পার্কটি গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের দখলে চলে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মাঠ ফিরে পাওয়ার দাবিতে একাধিকার মানববন্ধনও করেছেন স্থানীয়রা।

তারা বলছেন, এটা একটা সরকারি খেলার মাঠ। সেখানে টাকা দিয়ে সন্তানদের আসতে হবে- এটা রীতিমতো অন্যায়। অনেক কিছু করা হয়েছে মাঠের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাঠটি আর শিশুদের নেই। কারণ ‘এতো টাকা’ দিয়ে খেলতে পাঠানোর মতো অবস্থা অনেক পরিবারেরই নেই। অথচ এই মাঠ ছেড়ে দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে।

স্থানীয়রা আরও বলছেন, এককালের সর্বসাধারণের জন্য থাকা মাঠটিতে একপর্যায়ে ‘ফি দিয়ে’ খেলার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। সম্প্রতি সেই ফি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। একটি সরকারি মাঠ ব্যবহারের ফির নামে অস্বাভাবিক হারে অর্থ আদায়ে এলাকার সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ।

পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা এ নিয়ে একাধিকবার রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনকে অবহিত করলেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখন পার্কটি রাজউকের কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয় তখন কিছু শর্ত ছিল। সেব শর্তের মধ্যে ছিল এই মাঠ, পার্ক ও উদ্যান কোনও অবস্থাতেই কোনও তৃতীয় পক্ষের কাছে লিজ, ভাড়া বা হস্তান্তর করা যাবে না। মাঠ সংরক্ষণ করতে হবে। খেলার মাঠ ও পার্ক সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। কোনও স্থায়ী স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। মাঠের চারপাশে গাড়ি পার্কিং, স্থাপনা নির্মাণ না করে ওয়াকওয়ে করতে হবে।

কিন্তু এসব শর্ত মানা হয়নি। যার প্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পার্কের লিজ বাতিল, দখল হওয়া জায়গা উদ্ধার ও বেআইনি স্থাপনা অপসারণ করে সাধারণ মানুষদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে।

পবার আবেদনের পর ৩১ অক্টোবর রাজউক এক সাধারণ সভায় মাস্টারপ্ল্যানের বাইরের সব স্থাপনা অপসারণের কথা বলে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মাঠটি সাধারণ মানুষের জন্য। বরাদ্দপত্রের শর্ত ভেঙে নির্মিত অবৈধ স্থাপনা সাত দিনে উচ্ছেদ না করলে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে।

সেই সাধারণ সভার এসব সিদ্ধান্তের পর ৫ মাস চলে গেলেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। বরং এই সময়ে অবৈধ সেই ফি আরও বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

একটি সূত্র সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছে, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব সাধারণ মানুষদের মাঠে প্রবেশ করতে দেয় না। মাঠ ব্যাবহারের জন্য তারা ট্রেনিং একাডেমি করেছে। সেই একাডেমিতে টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে খেলতে হয়। খেলার জন্য আছে নির্ধারিত পোশাক, যা সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল।

মাঠের চারদিক গ্রিল দিয়ে ঘেরাও করা।

সূত্রটি আরও জানিয়েছে, সাধারণ শিশুরা মাঠে ঢুকে পড়লে তাদের বের হয়ে যেতে বলা হয়। মাঠের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করে মাঠটি এখন বাণিজ্যিক স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কমিউনিটি মাঠের নীতির বিপরীত। পার্ক কমিউনিটির কক্ষটি এখন গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের দখলে। তারা তাদের অফিস কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছে পার্ক কমিউনিটির কক্ষটি।

এসব বিষয়ে কথা বলতে সম্প্রতি গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের ওই অফিসে যান এই প্রতিবেদক।

অফিসের কর্মীরা সকাল সন্ধ্যাকে জানান, এই মাঠে দেড় ঘণ্টা ফুটবল খেলার জন্য টাকা নেওয়া হয় দুইভাবে। দুপুরে নেওয়া হয় পাঁচ হাজার। আর বিকালের জন্য আট হাজার। টেনিস খেলতে দুপুরের জন্য দিতে হয় আট হাজার। আর বিকালের জন্য ১০ হাজার টাকা। সুইমিং পুলের জন্য ভর্তি হতে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া পুল ব্যবহার করতে প্রতি ঘণ্টায় দিতে হয় ৭০০ টাকা। ক্রিকেট খেলার জন্য দুপুরে দিতে হয় তিন হাজার টাকা, বিকালে চার হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবেশবাদী এবং স্থানীয় বাসিন্দা জানান, মাঠটি মূলত ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের হাত ধরেই সাধারণ খেলার মাঠ থেকে ইয়ুথ ক্লাবের কাছে চলে যায়। ক্লাবের ডোনারের তালিকাতে এখনও নাম আছে দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের। মাঠে এখন বিভিন্ন কর্পোরেট উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ থাকলেও প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই।

“যেখানে উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষিত, সেখানে আমাদের প্রতিবাদে কিছু হবে না” ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ফারহানা ইসলাম।

শংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাজউক মাঠটি তাদের থাকা অবস্থাতেই পার্ক থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নোটিস দেয়। ২০১৩ সালের মার্চে সে নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গুলশান ইয়ুথ ক্লাব হাই কোর্টে রিট করে। ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট সে রিটের রায়ে আদালত বলে, পার্কের জায়গা দখলের কোনও আইনগত অধিকার ইয়ুথ ক্লাবের নেই।

উচ্চ আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, গুলশানের লে আউটে পার্কের জায়গা হিসেবেই রয়েছে এই মাঠ। পার্ক হিসেবেই এটি থাকবে। কোনও অবস্থাতেই প্লটে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। পার্ক ছাড়া অন্য কোনও কাজে প্লট ব্যবহার করা যাবে না।

উচ্চ আদালত পার্কটি পুনরুদ্ধার করারও নির্দেশ দেয়। পার্ক রক্ষায় প্লটে থাকা সব অনুমোদনহীন কাঠামো ভেঙে ফেলারও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের এ রায় উপেক্ষিতই থেকে গেছে।

এ প্রসঙ্গে পবার কার্যকরী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মাঠ ও পার্ক দখল বাণিজ্যিকিকরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় কাউন্সিল ও রাজনৈতিক নেতারা। আদালত মাঠ-পার্ক রক্ষায় কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।

“সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও স্থানীয় সরকার আদালতের নির্দেশনা আমলে নেয়নি। বরং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মাঠ-পার্ক পুনরায় ইজারা দিয়েছে এবং সেটি রক্ষায় কোনও কাজ করেনি। কিন্তু যারা এই নির্দেশ বাস্তবায়ন না করার নায়ক, তারা আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন আদালত অবমাননা করে।”

তিনি বলেন, “আশা করব, এখন আদালত স্বঃপ্রণোদিত হয়ে তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনবেন। কারণ আদালতের রায়কে বিনাপ্রশ্নে প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করা হয়।”

মাঠের বিষয়ে জানতে কথা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের সঙ্গে, যিনি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যানও।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমাদের কাছেও কিছু অভিযোগ এসেছে। আমরা এই একতরফা চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছি। অভিযোগ তো আগেও ছিল, আমাদের কাছেও এসেছে। আমরা চুক্তি বাতিল করে পাবলিকের কাছে এই পার্ক ফিরিয়ে দিচ্ছি।”

সেটা কবে নাগাদ হবে- প্রশ্নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব। পারলে এই মাসের ভেতরেই।”

আইন ও আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে মাঠ, পার্ক ইজারা দেওয়া বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করেন আইনজীবী ও নীতি বিশ্লেষক সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন।

তিনি বলেন, “আমরা বিগত দিনেও দেখেছি নগর কর্তৃপক্ষ মাঠ উদ্ধারে নানা অঙ্গীকার করে কিন্তু কোনও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসে না। মাঠ-পার্ক হতে ক্লাবগুলোকে উচ্ছেদ করতে হবে। মাঠে নগর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।”

যে সব ক্লাব মাঠ দখল করেছে, সরকারি সম্পদ দখল করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানান সৈয়দ মাহবুবুল আলম।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত