দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করেন শুল্কযুদ্ধ। প্রথম মেয়াদের বাণিজ্য যুদ্ধের রেশ ধরে শুরু করা এই যুদ্ধে এরইমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত মিত্ররাও সঙ্কটে পড়েছে।
শুল্ক আরোপের ঘোষণাটি মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্প গত এপ্রিলে “লিবারেশন ডে” উপলক্ষে দিয়েছিলেন। আর এতে এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাপানসহ যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান দেশগুলো (মূলত রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল) ট্রাম্পের বেধে দেওয়া ১ আগস্টের সময়সীমার আগেই বাণিজ্য চুক্তি করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন হলো শেষ পর্যন্ত কারা কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো হলো, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও ভারত। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে ছিল।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি ও সেমিকন্ডাক্টর পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত এপ্রিলে এসব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তবে দুই দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
দেশ দুইটি তাদের বাণিজ্য প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠিয়ে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ এই শুল্ক হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
২২ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাপানের সঙ্গে চুক্তিকে “ইতিহাসের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি” হিসেবে ঘোষণা দেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ৩০ জুলাই।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলো তাইওয়ান। তাদের ওপর শুল্ক হার ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। তবে চিপ শিল্পের ওপর আলাদা খাতভিত্তিক শুল্ক আরোপ হবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে শুক্রবার বলেন, বর্তমান শুল্ক হার “অস্থায়ী” এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা এখনও চলছে।
অস্ট্রেলিয়ার ওপর এপ্রিলে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনও বাড়তি শুল্কের মুখে পড়েনি। তবে প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের শুল্ক হার ১০ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী টড ম্যাকক্লে জানিয়েছেন, এটি “অন্যায্য” এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দূত জেমিসন গ্রিয়ারের সঙ্গে আলোচনার জন্য তারা উদ্যোগ নিচ্ছেন।
চীন ও ভারতের অবস্থা কী
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্ক সংক্রান্ত ঘোষণায় চীনের নাম উল্লেখ না থাকলেও তারা আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
মে মাসে জেনেভা, জুনে লন্ডন ও সম্প্রতি স্টকহোমে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক আলোচনা হয়েছে।
বিবিসির এশিয়া বিজনেস করেসপন্ডেন্ট সুরঞ্জনা তেওয়ারির মতে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টরসহ কিছু প্রযুক্তিপণ্যের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখার বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ সরবরাহে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের ওপর যে বিষয়গুলোতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ফেন্টানিল উৎপাদন কমানো, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির বাজারে প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের কেনাকাটা বাড়ানো ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া।
এদিকে ১২ আগস্ট শেষ হতে যাওয়া বাণিজ্য বিরতি আরও ৯০ দিন বাড়ানোর বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্পর্ক ‘সদ্ভাবপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হলেও ভারতের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার কারণে কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক দুই দেশের সম্পর্কে “বিরক্তির কারণ”।
এপ্রিলে ২৭ শতাংশ শুল্কের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা পরে স্থগিত হয়। বর্তমান ২৫ শতাংশ শুল্ক কিছুটা কম হলেও তা ভারতের জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আসিয়ান দেশগুলো: ভিন্ন ফলাফল, ভিন্ন বাস্তবতা
গত ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন শুল্কের ঘোষণা দিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওই অঞ্চলের অর্থনীতি মূলত রপ্তানিনির্ভর।
তখন কিছু দেশের ওপর সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। এর প্রভাব পড়ে ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম, চিপ উৎপাদনকারী মালয়েশিয়া এবং পোশাকশিল্পনির্ভর কম্বোডিয়ায়।
আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশের মধ্যে প্রথমেই ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং সফলভাবে শুল্ক হার ৪৬ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনে। হ্যানয়ের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের দেওয়া সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত জানানো হলেও এই চুক্তি অন্য দেশগুলোর জন্য মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক হার ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। ব্রুনাইয়ের ওপর আরোপিত হার কিছুটা বেশি, ২৫ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাওস ও মিয়ানমার। দেশ দুইটির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কেন দেশ দুইটির ওপর এত উচ্চ হারে শুল্ক দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে হেইনরিখ ফাউন্ডেশনের বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষক ড. ডেবোরা এলমস মনে করেন, বাজার প্রবেশে সীমাবদ্ধতা, ক্রয়ক্ষমতা কম এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক— এসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে সিঙ্গাপুরের শুল্ক হার অপরিবর্তিত রয়েছে, ১০ শতাংশ। কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বেশি, রপ্তানি করে কম।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শুল্ক হারের তারতম্য রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর সবচেয়ে কম, মাত্র ১৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। প্রতিবেশী ও প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের তুলনায় এটি অনেকটাই কম।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেকটাই উষ্ণ। জুনে পাকিস্তান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও দেয়।
এই তুলনামূলক কম শুল্ক পাকিস্তানের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। আর এর বেশিরভাগই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। অপরদিকে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপর বেশি হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
আফগানিস্তান, ফিজি, নাউরু ও পাপুয়া নিউগিনির ওপর শুল্ক হার ১৫ শতাংশ ও কাজাখস্তানের ওপর ২৫ শতাংশ।
তবে বিশেষজ্ঞ ড. এলমস মনে করিয়ে দেন, সাম্প্রতিক ঘোষিত হারগুলো চূড়ান্ত নয়।
তিনি বলেন, “নির্বাহী আদেশে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো পরিবর্তন করতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থাকে বাণিজ্য বাধা দূর করার ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি।