Beta
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

স্থলপথে ভারতে চামড়া ছাড়া অন্য সব পণ্য রপ্তানি বন্ধ

ভারতে রপ্তানির বেশির ভাগই হয় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে।
ভারতে রপ্তানির বেশির ভাগই হয় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে।
[publishpress_authors_box]

ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে একের পর এক বিধি-নিষেধ আরোপ করেই চলেছে পাশের দেশ ভারত।

মাস তিনেক আগে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল দেশটি। দেড় মাস আগে কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড় আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

সবশেষ সোমবার স্থলপথে পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের কাপড়, পাটের দড়ি বা রশি, পাটজাতীয় পণ্য দিয়ে তৈরি দড়ি বা রশি এবং পাটের বস্তা বা ব্যাগ আমদানিতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।

নতুন এই ঘোষণার ফলে স্থলপথে অর্থাৎ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা পাট ও পাটজাতীয় কোনও পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে পারবেন না। শুধু দেশটির মুম্বাইয়ের নভসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে এসব পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে।

এখন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া আর কোনও পণ্য স্থলপথে ভারতে রপ্তানির সুযোগ নেই। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা।

সোমবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য মহাপরিচালকের কার্যালয় (ডিজিএফটি) থেকে পাটপণ্য আমদানিতে বিধি-নিষেধের প্রজ্ঞাপন জারি করে।

বাংলাদেশ থেকে যে সব পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়, তার ৯৫ শতাংশই বেনাপোলসহ অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়। মাত্র ৫ শতাংশের মতো যায় সমুদ্রপথে।

অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, স্থলপথে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ কম পড়ত। রপ্তানিকারকরা লাভবান হতেন। এখন আর তা হবে না। ফলে সামগ্রিকভাবে রপ্তানি কমে যাবে। যে সরবরাহ শৃঙ্খলা বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে, তা চাপের মুখে পড়বে।

গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাবপত্র, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল ও ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয় প্রভৃতি পণ্য আমদানিতে বিধি-নিষেধ দিয়েছিল।

তার আগে ৯ এপ্রিল কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করেছিল দেশটি।

২৭ জুন আরেক প্রজ্ঞাপনে ডিজিএফটি বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কয়েক ধরনের পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছিল। স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বিধিনিষেধ দেওয়া ওই সব পণ্যের মধ্যে ছিল—কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা ও বিশেষ ধরনের কাপড়।

গত ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করার পর থেকেই ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েই চলেছে।

রপ্তানি কমছে ভারতে

গত বছর অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক বৈরিতার দিকে গড়ালেও বাণিজ্যে তার প্রভাব পড়ছিল না, বরং রপ্তানি বাড়ছিলই। তবে ভারত স্থলপথে পণ্য নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর এখন প্রভাব দেখা যাচ্ছে।

গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ভারতে ৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এই অঙ্ক আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৫ কোটি ডলার কম। মে মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।

হিসাব করলে দেখা যায়, জুনে মে মাসের চেয়ে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৩২ শতাংশ। এতে অর্থ বছরের সামগ্রিক হিসাবেও প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমে গেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারতে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।

অথচ ১১ মাসে (জুলাই-মে) হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (জুলাই-জুন) প্রতি মাসে গড়ে ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় ভারতে। ১১ মাসের (জুলাই-মে) হিসাবে গড়ে রপ্তানি আয় আসে ১৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার।

ভারতে প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল—তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক দ্রব্য। এছাড়া কিছু সুতা ও বস্ত্রজাত পণ্যও রপ্তানি হতো। প্রতিবেশী দেশটিতে মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই ছিল তৈরি পোশাক।

এসব পণ্যের প্রায় সবই রপ্তানি হতো স্থলপথে। এর মধ্যে বেশিরভাগই যেত বেনোপোল স্থলবন্দর দিয়ে।

এখন কেবল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানির সুযোগ নেই।

নতুন বাজার হিসাবে ভারতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল চোখে পড়ার মতো করে। পোশাক রপ্তানিকারকরা আশা করেছিলেন, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারতে ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হবে। সামগ্রিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে অর্থ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তা আগস্টের শুরুতেই গণবিস্ফোরণে রূপ নিলে পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তিনি আশ্রয় নেন ভারতে।

এরপর থেকে ঢাকা-নয়া দিল্লি কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

তার জেরেই ভারত সরকার ধাপে ধাপে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলারের মতো। অর্থাৎ বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে, তার অনেক কমই রপ্তানি করে থাকে।

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ভারতে পণ্য রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম।

প্রতিক্রিয়া

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসে ভারতে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। জুন মাসে তা অর্ধেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। মে মাসে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল; জুনে হয়েছে ৩ কোটি ৫ লাখ ডলার।

মে মাসে ১ কোটি ৭ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল; জুনে হয়েছে ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলার। মে মাসে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানি হয়েছিল; জুনে হয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার।

ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে উষ্মা প্রকাশ করে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতে আমাদের রপ্তানি আস্তে আস্তে ভালোই বাড়ছিল। এক সময় সামগ্রিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পোশাক রপ্তানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু এখন একটা বড় ধাক্কা খেলাম আমরা।

“স্থলপথে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর কোনও পোশাক স্থলপথে রপ্তানি হয়নি। আগে যে অর্ডারগুলো ছিল, সেগুলো বাধ্য হয়ে সমুদ্রপথে পাঠাতে হয়েছে। এতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়েছে। অনেকে অর্ডার থাকার পরও লোকসান হবে হিসাব করে রপ্তানি করেনি। সে কারণেই জুন মাসে রপ্তানি কমে গেছে। আগামী মাসগুলোতে আরও কমবে।”

ভারতের বাজারে বড় রপ্তানিকারকদের একটি বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশের প্রায় সব স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমরা বিভিন্ন ধরনের পানীয় থেকে শুরু করে কনফেকশনারি সামগ্রী, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ভারতের বাজারে রপ্তানি করতাম।

“ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় স্থলবন্দর ব্যবহার করে এসব সামগ্রী আমদানিতে যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে আমাদের পণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বলা যায়, আমাদের রপ্তানি প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “কিছু পণ্য আমরা সমুদ্রপথে রপ্তানি করছি। এতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি পড়ছে। আগামীতে এটা আর অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। কেননা, এত পরিবহন খরচ দিয়ে পণ্য রপ্তানি করলে লোকসান হবে।”

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) সভাপতি তাপস প্রামাণিক বলেন, “বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হয়, এমন সব পদক্ষেপই নিচ্ছে ভারত। আমরা সরকারকে আগেও বলেছি, এখন আবার বলব যেন এসব বিধিনিষেধের বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।”

ভারত সরকার কি আলোচনায় বসতে রাজি হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তাপস প্রামাণিক বলেন, “ট্রাম্প যদি পুতিনের সঙ্গে বসতে পারেন, তাহলে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কেন বসবে না? পাশাপাশি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের উচিত হবে পাটপণ্য রপ্তানির জন্য ভারতের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা।”

অর্থনীতির গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারত সরকারের এ সব সিদ্ধান্ত দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করবে। নিয়ন্ত্রণমূলক তদারকি একটি দেশের সার্বভৌম অধিকার। তবে এ ধরনের হঠাৎ ও বেছে বেছে স্থলবন্দরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, বিশেষ করে স্থলপথে বাণিজ্যের খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং অনিশ্চয়তা তৈরি করে।

“এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের পণ্যের জন্য প্রাকৃতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বাজার এবং সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত করা এই অঞ্চলের সীমান্তবর্তী বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসাগুলোর দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা ক্ষুণ্ন করবে।”

“আমি আশা করি, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতার চেতনায় এসব অশুল্ক বাধা পুনর্বিবেচনা করা হবে। গঠনমূলক সংলাপ ও বাণিজ্য সহজীকরণে আরও ভালো সমন্বয় উভয় দেশের জন্যই মসৃণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎসাহিত করতে সহায়ক হবে,” বলেন সেলিম রায়হান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত