শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই ১৩ বছর পর গোপনে তার দেশ পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নিজ গ্রামে গিয়েছিলেন। তালেবানের গুলি তার মাথায় লাগার পর তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
বর্তমানে ব্রিটিশ নাগরিক মালালা গত বুধবার তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে গোপনে তার গ্রামে যান। পরে তিনি সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি শেয়ার করেন। ওই ছবিতে তুষারাবৃত পাহাড় ও নদীর পটভূমির সামনে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা হয়।
মালালা বলেন, “এত বছর পর নিজের ঘরে ফিরে আসা খুবই আনন্দের বিষয়। পাকিস্তানে থাকার সময় শৈশবে প্রত্যেক ছুটিতে শাংলা নদীর পাশে খেলতাম। সেখানে পরিবারের সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া হতো।
“১৩ বছর পর আজ সেখানে ফিরে আসা আমার জন্য খুবই আনন্দের। পাহাড়গুলোর মাঝে থাকার, ঠাণ্ডা নদীতে হাত ডুবানোর এবং প্রিয় ভাইবোনদের সঙ্গে হাস্যরস করার মূহুর্তগুলো অমূল্য। এই জায়গা আমার খুবই প্রিয়। আশা করি আবারও এখানে ফিরে আসতে পারবো।”
২০১২ সালের অক্টোবরে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের মিংগোরার সোয়াত ভ্যালি থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল মালালাকে। স্কুল বাসে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তারপর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল তাকে, সেরে ওঠার পর সেদেশেই থেকে যান।
২০১৪ সালে ভারতের শিশু অধিকারকর্মী কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে মালালা শান্তিতে নোবেল পান।
গত ১৩ বছরে পাকিস্তানে মালালা কয়েকবার গেলেও, নিজের গ্রামে এবারই প্রথম গেলেন। হেলিকপ্টারে করে তিনি গ্রামে পৌঁছান। এসময় আশেপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়। কিছু এলাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এসময় তার সঙ্গে বাবা ও স্বামী ছিলেন।
পাকিস্তানের একজন সরকারি কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান, “কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সফরটি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছিল। স্থানীয়রাও তার আসার বিষয়ে জানতেন না।”
মালালা ইউসুফজাই বারকানা এলাকায় আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ পরিদর্শন করেন। সেখানে মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়।
উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা আমজাদ আলম খান বলেন, “মালালা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার আহ্বান জানিয়েছেন।” মালালা ফান্ড এই কলেজে বিনামূল্যে উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিতে দেওয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের বান্নু এলাকায় সামরিক ছাউনিতে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত ১৩ জন বেসামরিক নাগরিক ও পাঁচজন নিরাপত্তা কর্মীর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান মালালা।
পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে যুক্ত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। এতে ৪২ জন আহত হন। তাদের মধ্যে কিছুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মালালা বলেন, “আমাদের সুন্দর দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমি প্রার্থনা করি। বান্নুর সাম্প্রতিক হামলাসহ এসব ঘটনা হৃদয়বিদারক। আমি নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানাই এবং আমার দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করি।”
মালালা ইউসুফজাই ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মিনগোরায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জিয়াউদ্দিন ও মা তুর পেকাই ইউসুফজাই।
২০০৭ সালে মাওলানা ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানি তালেবানের একটি শাখা দেশের উত্তর-পশ্চিমের সোয়াত উপত্যকা দখল করে। কট্টর ইসলামি শরিয়াহ আইনের বলে টেলিভিশন দেখা বন্ধ করে, গান-বাজনা নিষিদ্ধ করে। আর পরের বছর মেয়েদের লেখাপড়া নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে তারা প্রায় ১৫০টি স্কুল বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়।
এই পরিস্থিতি মেয়েদের শিক্ষার ওপরে কী প্রভাব ফেলছে, তা জানতে বিবিসির উর্দু ওয়েবসাইট একটি উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগ থেকেই ছদ্মনাম গুল মাকাই নামে ডায়েরি লিখত শিশু মালালা। সেই ডায়েরি বিবিসির ইংরেজি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
অচিরেই বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে সেই ডায়েরি সংবাদ হিসেবে জায়গা করে নেয়। ২০০৯ সালে মালালা ও তার বাবা জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে নিউ ইয়র্ক টাইমস। ২০১১ সালে পাকিস্তানি সেনারা সোয়াত উপত্যকা থেকে তালেবানকে পিছু হটতে বাধ্য করে। মালালা আবার স্কুলে ফিরে আসে।
এরপর গুল মাকাই মালালা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করে। ওই ডায়েরি পাকিস্তানে বা বাইরে যে আলোড়ন ফেলেছিল, তাতে ওই পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ছিল।
২০১২ সালের ৯ অক্টোবর স্কুল থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হয় কিশোরী মালালা। স্কুলের গাড়িতে মালালা ও তার দুই বান্ধবী তালেবানের গুলিতে আহত হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয় মালালাকে। সুস্থ হয়ে সেখানেই পড়াশোনা শুরু করেন।
মালালার নামে জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে। ২০১৩ সালের ১২ জুলাই তার ১৬তম জন্মদিনে ‘মালালা দিবস’ ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ওই বছরই গঠন করা হয় মালালা ফান্ড। নারী শিক্ষার উন্নয়নে ফান্ডটি কাজ করে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন