Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

রাখাইনে বড় যুদ্ধের প্রস্তুতিতে আরাকান আর্মি, জড়িয়ে চীন-ভারতের স্বার্থ

রাখাইনে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে ফেলেছে আরাকান আর্মি।
রাখাইনে নিজেদের পতাকা উড়িয়ে ফেলেছে আরাকান আর্মি।
[publishpress_authors_box]

মিয়ানমারের পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে আরাকান আর্মি (এএ) যত কাছাকাছি আসছে, রাখাইন রাজ্য ততই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণের মুখোমুখি হচ্ছে। এই ক্ষমতা পরিবর্তন দেশটির গৃহযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি উভয়কেই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশের অন্য এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ অনেকটা ফিরে পেলেও রাখাইনে চিত্র ভিন্ন। আরাকান আর্মি এখন রাখাইনের ১৭টি শহরের ১৪টি নিয়ন্ত্রণ করছে।

বঙ্গোপসাগর পাড়ের বাংলাদেশ লাগোয়া এই রাজ্যটির কৌশলগত গুরুত্ব অনেক, তাই এর সঙ্গে আঞ্চলিক নানা স্বার্থও জড়িত।

রাখাইনের রাজধানী সিত্তে দখলের বাকি আরাকান আর্মির। সিত্তের পাশাপাশি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর প্রকল্প এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা তেল ও গ্যাস পাইপলাইন ও গভীর সমুদ্র বন্দর কিয়াউকপিউ দখল করতে চাইছে বিদ্রোহী দলটি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মির এখন একটি চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর সুযোগ।

তবে রাখাইনে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীটির গুরুতর নির্যাতনের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অবরোধের কারণে রাখাইনে মানবিক সঙ্কট বেড়েই চলেছে। জাতিসংেঘর ধারণা, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে।

এই মাসের শুরুতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (এফএও) সতর্ক করেছিল যে মধ্য রাখাইনে ৫৭ শতাংশ পরিবার তাদের মৌলিক খাদ্য চাহিদা মেটাতে পারছে না, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৩৩ শতাংশ।

সিত্তের অবরুদ্ধ এলাকায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ আটকে পড়েছে, যেখানে এখন কেবল সাগর ও আকাশ পথ ছাড়া যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

সিত্তের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সেখানে নিত্যপণ্যের এখন আকাশছোঁয়া দাম। যে শূকরের মাংসের দাম এক সময় ২ ডলার ছিল, তা এখন ১৩ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার কারণে হতাশ মানুষ আত্মহত্যা করছে, ভিক্ষাবৃত্তির দিকে ঝুঁকছে, যৌনকর্ম বাড়ছে এবং দিনের বেলায়ও চুরি হচ্ছে।

সম্প্রতি সিত্তে ছেড়ে আসা এক ব্যক্তি বলেন, “দিনের বেলায়ও বাড়িঘরে ঢুকে পড়ে তারা; সবকিছু নিয়ে যায়।”

সিত্তেতে এখনও থাকা এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী স্থানীয় জনগণের কথোপকথন পর্যবেক্ষণ করে। যখন সৈন্যরা বাড়িগুলোতে অভিযান চালায়, তখন দেখে বাসিন্দাদের শরীরে আরকান আর্মির ট্যাটু আছে কি না?

আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর একজন প্রতিনিধি সিত্তেকে সামরিক শাসনের একটি কঠোর উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে বলেন, দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী আরাকান বা রাখাইনক দখলকৃত ভূখণ্ড হিসাবেই বিবেচনা করে আসছে।

বেসামরিক মৃত্যু বাড়ছেই

আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে বিমান হামলা চালাচ্ছে সামরিক বাহিনী। ২০২১ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সারাদেশেই এই কৌশল ব্যবহার করছে জেনারেলরা।

ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) দাবি করছে, ২০২৩ সালের শেষের দিক থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিমান হামলায় ৪০২ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯৬ জন শিশু।

তারা আরও জানায়, এই বছর গোলাবর্ষণ, স্থলমাইন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে আরও ২৬ জন বেসামরিক লোক মারা গেছে।

ইউএলএ’র একজন প্রতিনিধি বলেন, বেসামরিক মানুষদের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে কোনও ফল আসবে না। বরং একে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলা যায়।

সংঘাত বাড়তে থাকার মধ্যে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উভয়ই তাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করতে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেছে।

‘জাতীয় মুক্তি’র লক্ষ্যে চালানো লড়াই বেগমান করতে আরাকান আর্মি মে মাস থেকে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারীদের দলভুক্ত করছে। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী আনুমানিক ৭০ হাজার পুরুষকে সৈনিক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে যুক্ত করেছে এই যুদ্ধে।

রাখাইনে ২০১৭ সালে সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়ন ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। তখন সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালায় বলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাও চলছে।

আবার আরাকান আর্মিও রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ৬০০ জনকে হত্যার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। তবে বিদ্রোহী দলটি সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে।

বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক শাখা ইউএলএ’র দাবি, রাখাইনে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় মুসলিম বাসিন্দারা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো জীবনযাপন করছে।

ইউএলএও সামরিক সরকারের মতোই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে চায় না। তারাও বোঝাতে চায় যে এই সম্প্রদায়টি রাখাইনের আদি বাসিন্দা নয়।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে তখন, যখন সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিনের আচরণের বিপরীতে গিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সতর্ক করেছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদেরও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্ররোচিত করছে।

কিন্তু আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে একটি রোহিঙ্গা বিদ্রোহ সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না আইসিজি।

চীন নির্মিত বন্দরের জন্য যুদ্ধ

সিত্তের দক্ষিণে কিয়াউকপিউর জন্য একটি চূড়ান্ত লড়াই আসন্ন, যা দুটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইন এবং একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই বন্দরটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো প্রকল্পের অংশ।

ব্যাংককভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রকাশনা জেনেস’র বিশ্লেষক অ্যান্থনি ডেভিস পূর্বাভাস দিয়েছেন, আরাকান আর্মি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে একটি অভিযান শুরু করতে পারে। তারা মেঘলা আকাশকে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমানের বিমান হামলা থেকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করবে, যা কিয়াউকপিউ দখলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে।

ডেভিস বলেন, ২০২৪ সালে আরাকান আর্মি যে গোলাবারুদ জমিয়েছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে কমে যেতে পারে, আবার চীনের চাপে উত্তর মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ কমতে পারে। সেই কারণেই আরাকান আর্মির অভিযোগ শুরু করার এত তাড়া।

বর্তমানে সেনাবাহিনীর ৩ হাজার পদাদিক সৈন্য, জেট, ড্রোন এবং নৌবাহিনী কিয়াউকপিউর নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে।

ডেভিস বলেন, আরাকান আর্মির নতুন নিয়োগে তারা ৪০ হাজার সদস্যের বাহিনীতে রূপ নেবে। সম্ভবত কিয়াউকপিউ আক্রমণে ১০ হাজারের বেশি সৈন্য নিযুক্ত করবে।

আরাকান আর্মির বন্দরটি দখল করার সক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক, তাহলে তা হবে গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

চীনের একটি সূত্র অনুযায়ী, কিয়াউকপিউতে প্রায় ৫০ জন চীনা নিরাপত্তা কর্মী রয়েছে।

ডেভিস ধারণা করেন, িনজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকার নিশ্চয়তা পেলে হয়ত বেইজিং আরাকান আর্মিকে সমর্খন দেবে।

যদিও বেইজিং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের প্রতি তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে; তবে ইউএলএ’র প্রতিনিধি বলেন, চীনের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য সব উপায় অবলম্বনে তারা সচেষ্ট।

যুদ্ধের বিস্তার বাড়ছে

রাখাইনে কালাদান পরিবহন প্রকল্পের কারণ স্বার্থ রয়েছে ভারতেরও। এই প্রকল্পের লক্ষ্য দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সিত্তে বন্দরের মাধ্যমে সমুদ্র পথে সংযুক্ত করা। এই করিডোর ভারতকে বাংলাদেশকে পাশ কাটিয়ে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরি করে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, রাখাইনে বন্দর, সড়ক ও নদী নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মিকে ভারতীয় বাণিজ্য থেকে কর আদায়ের সুযোগ করে দিতে পারে; যা তার আর্থিক সক্ষমতা বাড়াবে এবং একই সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নতুন দিল্লির সম্পর্ককে দুর্বল করবে।

যদি আরাকান আর্মি রাখাইনের উপকূলীয় বন্দরগুলো দখল করতে সফল হয়, তবে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি চীন এবং ভারত উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন এবং বাণিজ্য প্রবেশদ্বারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে, যা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্য যে কোনও সশস্ত্র গোষ্ঠীর চেয়ে তাদের শক্তিতে এগিয়ে দেবে।

ডেভিস বলেন, এটা ঘটলে তা আরাকান আর্মি সমর্থিত আরাকান পিপলস রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্টকে একটি আঞ্চলিক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমার বলছে, আরাকান আর্মি রাখাইনের বাইরেও তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে এবং এখন দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সবচেয়ে বড় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে।

“অন্য কোনও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশের পরবর্তী প্রজন্মের যোদ্ধাদের মধ্যে এত বিস্তৃত প্রভাবের জাল বুনতে পারেনি।”

কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেই সামরিক সরকার যখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন এমন ঘটতে পারে যে আরাকান আর্মি যুদ্ধবিরতিতে যাবে, আবার এমনও হতে পারে যে লড়াই চালিয়ে যাবে।

তবে ইউএলএ’র প্রতিনিধির কথায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতই মিলছে। তিনি বলেন, “এবার আমরা আত্মবিশ্বাসী যে প্রতিরোধ বাহিনী দেশে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারবে।”

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত