Beta
সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫

ট্রাম্পের শুল্ক হুমকিকে ‘অযৌক্তিক’ বলছে দিল্লি

Modi_and_Trump
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সেই ‘হাউডি মোদী’র সঙ্গে দ্বিতীয় মেয়াদে আর সম্পর্ক ভালো নেই। করমর্দনের সম্পর্ক এখন হুমকি ও হতাশায় রূপ নিয়েছে।

রাশিয়া থেকে তেল কেনার কারণ দেখিয়ে ভারতের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত সরকারও। তারা এই হুমকিকে ‘অন্যায্য ও অযৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেছে।

এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে দেওয়া এক পোস্টে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানান, তিনি ভারতের ওপর শুল্ক বাড়াবেন। কারণ ভারত “রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্র ইউক্রেনে কত মানুষকে হত্যা করছে, তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়।”

বর্তমানে ভারত রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার ‘অভিযানের’ পর ইউরোপের অনেক দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য কমিয়ে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ভারত মস্কোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাজারে পরিণত হয়।

ছাড়মূল্যে তেল বিক্রির কারণে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। ব্লুমবার্গের ট্যাংকার ট্র্যাকিং তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে প্রতিদিন গড়ে ভারত প্রায় ১৭ লাখ ব্যারেল রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল কিনেছে।

ব্লুমবার্গ ও কেপলারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ভারত প্রতিদিন গড়ে ১৪ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত জ্বালানি রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ডিজেল ও গ্যাস অয়েলের চালান ছিল মোট রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ। আর পেট্রোল ও মিশ্রণ উপাদান ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ।

তবে ভারতের রপ্তানিকৃত জ্বালানির ঠিক কতটুকু রাশিয়ান তেল থেকে উৎপন্ন, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ তেল পরিশোধনাগারগুলো বিভিন্ন দেশের অপরিশোধিত তেল মিশিয়ে ব্যবহার করে এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি তৈরি করে। 

গত সপ্তাহের শেষের দিকে অন্তত চারটি ট্যাংকার ভারতের পরিশোধনাগারে বিপুল পরিমাণ রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, তীব্র নজরদারির মধ্যেও এসব ডেলিভারি স্বাভাবিকভাবেই চলমান রয়েছে।

ভারতের ওপর নতুন শুল্ক কত শতাংশ হবে, তা ট্রাম্প সুনির্দিষ্ট করে বলেননি। তবে কিছুদিন আগেই তিনি দেশটির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে জানান, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বর্থে যুদ্ধ শুরুর সময় যুক্তরাষ্ট্রই ভারতকে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে উৎসাহিত করেছিল।

তিনি বলেন, “সংঘাত শুরুর পর ইউরোপে প্রচলিত জ্বালানি সরবরাহ চলে যাওয়ায় ভারত রাশিয়া থেকে আমদানি শুরু করে।”

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। এই অংশীদারের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে সমালোচনা করেছে নয়াদিল্লি। তাদে মতে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এখনও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করছে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে আনুমানিক সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাণিজ্য করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “যেকোনও বড় অর্থনীতির মতোই ভারত তার জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। ভারতকে টার্গেট করে এই পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।”

সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সোশাল মিডিয়া পোস্টে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে। সেখানে বলা হয়, এ দুই পক্ষ এখনও রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য কিনছে। অথচ তাদের এমন বাণিজ্য কোনও জাতীয় বাধ্যবাধকতার ফল নয়। 

ভারতীয় কর্মকর্তারা মনে করেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানির মাধ্যমে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য কমছে, যা ট্রাম্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল ১১তম সর্বোচ্চ। তবে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন মোদী সরকার এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে কৃষি ও দুগ্ধ খাতের মতো সংবেদনশীল খাতগুলোতে প্রবেশাধিকার দিতে অনিচ্ছুক।

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয়দের স্থানীয় পণ্য কেনার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখবে।

এসব ঘটনার মধ্যেও গত সপ্তাহে ট্রাম্প ভারতকে “বন্ধু” হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু তারপরেও বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে আমেরিকান পণ্যের ওপর শুল্ক “অত্যন্ত বেশি”। একই সময়ে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে ভারতকে “শাস্তির” হুমকিও দেন।

ট্রাম্প সম্প্রতি ট্রুথ সোশালে ভারত সম্পর্কে আবারও কড়া মন্তব্য করেন। তিনি লেখেন, “ভারত শুধু বিপুল পরিমাণে রাশিয়ার তেল কিনছে না, বরং তাদের কেনা তেলের একটি বড় অংশ খোলা বাজারে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছে। এই কারণে আমি ভারতের ওপর শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে যাচ্ছি।”

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় রিফাইনারিগুলোকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করার নির্দেশ দেননি।

ভারতের সাবেক বাণিজ্য কর্মকর্তা ও দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের প্রধান অজয় শ্রীবাস্তব বিবিসিকে বলেন, “ট্রাম্পের অভিযোগ বিভ্রান্তিকর ও বাস্তবতা উপস্থাপন করে না। ভারতের তেল বাণিজ্য স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যাপারটি সম্পর্কে সচেতন।”

শ্রীবাস্তব বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় ভারত তেল আমদানি বাড়িয়েছে, যাতে বৈশ্বিক বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং দামে বড় ধরনের ধাক্কা না আসে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের তেল শোধনাগারগুলো (সরকারি ও বেসরকারি) তেল কোথা থেকে কিনবে তা নিজেরাই নির্ধারণ করে। তারা দাম, সরবরাহ নিরাপত্তা এবং রপ্তানি বিধির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

সম্প্রতি তামিল উইকলিতে প্রকাশিত কার্টুন।

ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর শুরুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিনি আবারও কড়া অবস্থান নিয়েছেন এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশে কঠোর ভাষা ব্যবহার করছেন।

সম্প্রতি ট্রুথ সোশালে ট্রাম্প রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে “ রাশিয়ান ওয়ার মেশিন” বা রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রশ্ন তোলেন, পুতিন আসলেই কি শান্তি চান?

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্য বেশ কয়েকবার বলেছেন, তিনি শান্তি চান, তবে শর্ত হিসেবে ইউক্রেনকে রাশিয়ার দখলে থাকা কিছু এলাকা স্বীকৃতি দিতে হবে।

আর ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির কোনও চুক্তি না হলে রাশিয়ার তেলসহ অন্যান্য রপ্তানির ওপর কঠোর শুল্ক আরোপ করা হবে। সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ আগস্ট পর্যন্ত।

এই সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন। সেখানে তার পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। উইটকফের চেষ্টা থাকবে পুতিনকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানো।

রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের বাড়তি উদ্যোগের ফলে ভারত এখন এক রকম চাপে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি দ্রুতই রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ করবেন। কিন্তু পুতিনের কঠোর শর্ত এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় অনীহা ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত