আসছে ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে। তার সাত মাস আগে চালানো একটি জরিপে দেখা গেল, অর্ধেক ভোটারই এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে কাকে ভোট দেবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) গত জুলাইয়ে এই জরিপ পরিচালনার পর সোমবার তার ফলাফল তুলে ধরেছে।
বিশাল সংখ্যক ভোটারের সিদ্ধান্তহীনতার পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সংযোগ রয়েছে বলে ধারণা করছেন এই জরিপ পরিচালনাকারীরা।
তারা বলছেন, সিদ্ধান্ত না নেওয়া এই ভোটারের মধ্যে বড় অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক হতে পারে। প্রতিকুল পরিস্থিতির কারণে তারা এখন সরাসরি কথা বলছে না।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান পরিবর্তন করে ক্ষমতায় থেকেই তিনটি নির্বাচন করে টিকে ছিল।
২০২৪ সালে বিরোধীদলবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করলেও আট মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে।
এরপর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি দলটির অনেক নেতা। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে আছেন ভারতে। ফলে দলটি রয়েছে ছন্নছাড়া অবস্থায়।
গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বছর পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন।
তার এক সপ্তাহের মধ্যে বিআইজিডি জুলাই মাসজুড়ে চালানো তাদের জরিপের ফলাফল প্রকাশ করল। এই জরিপ পরিচালনায় তাদের সহযোগিতা করেছে ‘ভয়েস ফর রিফর্ম’।
দেশের ৬৪ জেলার ৫ হাজার ৪৮৯ জন ভোটারের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার মাধ্যমে ‘বিআইজিডি পালস সার্ভে ফাইন্ডিংস জুলাই ২০২৫’ শীর্ষক এই জরিপ চালানো হয়।
এর মধ্যে গ্রামের ভোটার ৭৩ শতাংশ, শহরের ভোটার ২৭ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া মোট ভোটারের ৪৭ শতাংশ নারী এবং ৫৩ শতাংশ পুরুষ।
জরিপে দেখা যায়, আগামী নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবে, ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটার সেই বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জরিপে অংশ নেওয়া ১২ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা ভোট দেবে বিএনপিকে; ১০ দশমিক ৪ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছে; ২ দশমিক ৮ শতাংশ জানিয়েছে যে তারা ভোট দেবে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি)।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলেও বিআইজিডির জরিপে অংশ নেওয়া ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে, তারা ভোট দেবে নৌকায়।
সোমবার ঢাকার আগারগাঁয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আর্কাইভ মিলনায়তনে জরিপের ফল প্রকাশের পর বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসান বলেন, “জরিপে অংশ নেওয়া যে ৪৮ শতাংশ ভোটার কাকে ভোট দেবেন বলে সিদ্ধান্ত জানাননি, তার উল্লেখযোগ্য অংশে আওয়ামী লীগের ভোটার লুকিয়ে থাকতে পারে।
“বিগত এক বছর ধরে বা জরিপ চলাকালীন সময় তাদের জন্য উদ্দীপনামুলক সময় নয় বলে তারা হয়ত আওয়ামী লীগের কথা বলেননি। যে ৭ শতাংশের বেশি ভোটার বলেছেন, তারা হয়ত আওয়ামী লীগের পাঁড় ভোটার হতে পারেন।”
সব দলের অংশগ্রহণে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০ আসনে জয়ী হয়েছিল। বিএনপি ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পেলেও জিতেছিল ৩০ আসনে। জামায়াত ৪ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২টি আসন পেয়েছিল।
অভ্যুত্থানের পর গত বছরের অক্টোবর মাসেও এই ধরনের আরেকটি জরিপ চালিয়েছিল বিআইজিডি, তখন সিদ্ধান্তহীন ভোটারের সংখ্যা ছিল এবারের চেয়ে কম।
বিআইজিডির পরিচালক সৈয়দা সেলিনা আজিজ বলেন, ওই জরিপে ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ ভোটার আগামী জাতীয় নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছিল।
ওই জরিপে বিএনপির পক্ষে সমর্থন ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ, জামায়াতের পক্ষে ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তখনও ৮ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছিল। ওই সময় এনসিপি গঠিত হয়নি।
দুই জরিপের ফলাফলের তুলনা করে বিআইজিডি পরিচালক সেলিনা বলেন, “এবার প্রধান তিন দলেরই ভোট কমেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪ শতাংশ পয়েন্টের বেশি ভোট কমেছে বিএনপির। পাশাপাশি জামায়াতের কমেছে প্রায় ১ শতাংশ পয়েন্ট এবং আওয়ামী লীগের কমেছে দেড় শতাংশ পয়েন্টের বেশি।”
দুই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিআইজিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক মির্জা এম হাসান বলেন, প্রথম জরিপের তুলনায় দ্বিতীয় জরিপে ভোট কমে যাওয়ার তথ্য বিএনপির জন্য দুঃশ্চিন্তার হওয়া উচিৎ।
“দীর্ঘদিন পরে, বিশেষ করে শেখ হাসিনা রেজিম চেঞ্জ হওয়ার পর বিএনপি ভোটে যাচ্ছে। এর মধ্যে আগের জরিপের তুলনায় বিএনপির ভোটের হার কমে যাওয়াটা অবশ্যই তাদের জন্য দুঃশ্চিন্তার কারণ।”
বিআইজিডির আরেক জ্যেষ্ঠ গবেষক আসিফ শাহান জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করে ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল জামায়াত। আবার ১৯৯৬ সালে একক নির্বাচন করে তারা প্রায় ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সে হিসাবে জামায়াতের ভোটার বেড়েছে, তা বলা যাবে না।
তবে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদাতাদের দল এনসিপির পক্ষে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ সমর্থনকে ‘বিস্ময়কর’ বলে মন্তব্য করেন মির্জা হাসান।
জরিপে অংশ নেওয়া ভোটারের মধ্যে ৭০ শতাংশ আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করছেন। তবে ১৫ শতাংশ বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।
৩২ শতাংশ মতামতদাতা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন চাইছেন, ২৫ শতাংশ চাইছেন ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের পর নির্বাচন। ১২ শতাংশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ভোটারের মধ্যে ৫১ শতাংশ ভালোমতো সংস্কারের পরে নির্বাচন চেয়েছেন বলে জানানো হয়।
সেলিনা আজিজ বলেন, ভালোমতো সংস্কারের পর নির্বাচন দেওয়া উচিৎ বলে জানিয়েছেন ৫১ শতাংশ। ১৭ শতাংশ বলেছেন কিছু জরুরি সংস্কারের পর নির্বাচন, ১৪ শতাংশ বলেছেন সংস্কার বাদ দিয়ে নির্বাচন আগেভাগে দিতে।
৮০% মানুষ মব সহিংসতায় উৎকণ্ঠিত
জরিপের অন্যান্য তথ্য উপস্থাপনের সময় সেলিনা আজিজ বলেন, জরিপে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন।
এরমধ্যে ৫৬ শতাংশ মানুষ মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে, ৬১ শতাংশ মানুষ রাতে চলাফেরা নিয়ে এবং ৬৭ শতাংশ মানুষ পোশাকের জন্য রাস্তা-ঘাটে হয়রানির আশঙ্কার কথা বলেছেন।
এই জরিপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের মুল্যায়নে তাদের প্রতি জনসমসর্থন কমেছে বলেও দেখা যাচ্ছে।
২০২৪ সালে পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ১০০ নম্বরের মধ্যে গড়ে ৭৫ নম্বর দিয়েছিল। এবারের জরিপে গড় নম্বর কমে হয়েছে ৬৩।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপনের এই অনুষ্ঠানে বিআইজিডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভয়েস ফর রিফর্ম’র কো- কনভেনর এ কে এম ফাহিম মাশরুরও উপস্থিত ছিলেন।