Beta
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

‘রিঅ্যাকশন টাইম’ পরীক্ষা করুন নিজেই, জানুন স্বাস্থ্য কেমন

health-examination
[publishpress_authors_box]

মানুষের জীবন যত এগোতে থাকে তত তার ‘রিঅ্যাাকশন টাইম’ বা ‘প্রতিক্রিয়ার সময়’ ধীরগতির হতে থাকে। এই কারণেই ৩০ বছর বয়স থেকে অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স কমতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে এসেছে, গড় প্রতিক্রিয়ার গতি বজায় রাখতে পারাটা মস্তিষ্কের শেষ বয়স পর্যন্ত কাজ করতে পারার একটি প্রধান লক্ষণ। 

তবে ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ মস্তিষ্কে কার্যক্ষমতার পাশাপাশি হৃদরোগ এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকিসহ শরীরের ভেতরের অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।

স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মস্তিষ্ক এবং জ্ঞানীয় বার্ধক্য বিষয়ক অধ্যাপক সাইমন কক্স বলেন, “কিছু মানুষ এমনিতেই অন্যদের চেয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখান, এমনকি বার্ধক্যের প্রভাব শুরু হওয়ার আগেও। তবে ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ কমে যাওয়া সম্ভবত বার্ধক্যজনিত অবনতির ইঙ্গিত দেয়। এটি এমন একটি নির্দেশক যা আমাদের অনেক জৈবিক সিস্টেমের সম্মিলিত কার্যকারিতা সম্পর্কে অনেক কিছু বলে।”

কিন্তু কীভাবে আপনি নিজের ঘরে বসে প্রতিক্রিয়া সময় পরিমাপ করবেন?

একটি সহজ পরীক্ষা হলো ‘রুলার ড্রপ টেস্ট’। এর জন্য আপনার পরিবারের সদস্য বা বন্ধুর সাহায্য এবং একটি রুলারের প্রয়োজন হবে।

একটি চেয়ারে বসুন, টেবিলের উপর আপনার হাত এমনভাবে রাখুন যাতে আপনার কব্জি টেবিলের প্রান্ত থেকে ঝুলে থাকে এবং বুড়ো আঙুল ও তর্জনী উপরের দিকে থাকে।

আপনার সঙ্গীকে বলুন আপনার হাতের উপরে একটি রুলার লম্বাভাবে ধরে রাখতে, যেখানে ‘শূন্য’ সংখ্যাটি আপনার বুড়ো আঙুলের সাথে সমানভাবে থাকে।

কোনো রকম সতর্ক না করে আপনার সঙ্গীকে রুলারটি ছেড়ে দিতে বলুন এবং আপনাকে যত দ্রুত সম্ভব সেটি ধরতে হবে।

রুলারটি ধরার আগে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, সেটি আপনার প্রতিক্রিয়া সময়ের পরিমাপ।

সাধারণভাবে, ৭.৫ সেন্টিমিটারের কম দূরত্বে রুলার ধরতে পারলে চমৎকার পারফরম্যান্স, ৭.৫-১৫.৯ সেন্টিমিটারের মধ্যে ধরলে গড় থেকে ভালো, ১৫.৯-২০.৪ সেন্টিমিটারের মধ্যে ধরলে গড় এবং ২০.৪ সেন্টিমিটারের বেশি হলে গড় থেকে খারাপ এবং ২৮ সেন্টিমিটারের বেশি হলে দুর্বল পারফরম্যান্স ধরা হয়।

রুলার ড্রপ টেস্ট

জনসংখ্যাভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিক্রিয়া সময় কমে যাওয়ার গতির সাথে অনেক বার্ধক্যজনিত রোগের ঝুঁকির সম্পর্ক রয়েছে। একজন ব্যক্তির সার্বিক মৃত্যুর ঝুঁকির পাশাপাশি, নির্দিষ্ট কিছু রোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকির সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে রয়েছে করোনারি হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ।

কোনও মানুষের ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ দেরি হওয়ার সঙ্গে তার স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের ক্ষমতা হারানো এবং ডিমেনশিয়ার শুরুর সম্পর্কও রয়েছে।

তবে, কক্সের মতে, কেবল একবার বা দুইবার হঠাৎ করে ‘প্রতিক্রিয়া সময়ে’র পরিমাপ খুব বেশি কিছু প্রকাশ করে না। কারণ লিঙ্গ, জিনগত বৈশিষ্ট্য, শারীরিক সুস্থতা, জীবনযাত্রার অভ্যাস এবং এমনকি ব্যক্তিত্বের ধরনসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের প্রতিক্রিয়া গতি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। কক্স উল্লেখ করেন, সময়ের সাথে একই পরীক্ষায় আপনার পারফরম্যান্সের তুলনা করলে প্রতিক্রিয়া গতি কীভাবে পরিবর্তিত হয়, সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতি বছর পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে প্রতিক্রিয়া গতি আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখ করার মতো কমতে শুরু করেছে কিনা।

কক্স বলছেন, মানুষের প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা আসলে বিভিন্ন সংবেদনশীল সিস্টেমের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করে। আমরা কতটা ভালোভাবে দেখি, শুনি বা গন্ধ পাই, আমাদের মস্তিষ্ক সেই তথ্য কতটা দ্রুত প্রক্রিয়াজাত করে প্রতিক্রিয়া সংকেত পাঠায় এবং আমাদের স্নায়ু, পেশী ও টেন্ডনগুলো মস্তিষ্কের নির্দেশ কতটা দ্রুত কার্যকর করে, এই সব কিছুর সমন্বয়েই প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা তৈরি হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই নেটওয়ার্কের প্রতিটি অংশ দুর্বল হতে পারে, তবে সবার ক্ষেত্রে একই রকম হয় না।

রুলার ড্রপ টেস্টে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য দুটি জিনিস প্রয়োজন:

১. মস্তিষ্ককে বুঝতে হবে রুলারটি পড়ে যাচ্ছে।

২. রুলারটি ধরার জন্য মস্তিষ্ক যে নির্দেশ দেয়, শরীরকে সেই নির্দেশ দ্রুত পালন করতে হবে।

গবেষকরা দেখেছেন, মধ্যবয়স থেকে শরীরের দ্রুত কাজ করার ক্ষমতা কমতে শুরু করে। তাই, মস্তিষ্ক দ্রুত বুঝলেও, শরীর দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে না।

কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল অধ্যাপক আলা আহমেদ আবিষ্কার করেছেন যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ মস্তিষ্কের চেয়ে সামগ্রিক শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর বেশি নির্ভর করতে পারে। তিনি বলেন, “হয়তো এর পেছনের কারণ হলো দ্রুত পেশী তন্তুগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়া, যা আমাদের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর শারীরিক ক্ষমতাকে সক্ষম করে। অথবা আমাদের কোষের মধ্যে শক্তি তৈরিকারী মাইটোকন্ড্রিয়া কম কার্যকরভাবে কাজ করে। ফলে আমরা দ্রুত নড়াচড়া করতে কম সক্ষম হই।”

আহমেদের মতে, শারীরিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায়, বয়স্ক ব্যক্তিরা দ্রুত নড়াচড়া করার পরিবর্তে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর উপর বেশি নির্ভর করেন। অর্থাৎ, তারা দ্রুত নড়াচড়া করতে না পারলেও, কোনো বিপদ দেখলে বা শুনলে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করেন।

একজন মানুষের ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ তাদের মানসিক (জ্ঞানীয়) এবং শারীরিক সুস্থতা উভয়ের প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

কক্স বলেন, “দ্রুত প্রতিক্রিয়ার প্রয়োজন হয় এমন স্পোর্টস পারফরম্যান্স অনুশীলনে মস্তিষ্ক ও শরীর দুটোই উন্নত হয়ে ‘প্রতিক্রিয়া সময়’ এর উন্নতি হতে পারে। এছাড়া কিছু বিজ্ঞাসভিত্তিক প্রমাণ আছে যে, সামাজিকভাবে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয় থাকা জটিল চিন্তা করলে জ্ঞানীয় বার্ধক্য ধীর হয়ে যায়।”

বয়স হওয়ার পরও আমরা যদি তুলনামূলকভাবে সুস্থ থাকি, তবে আমাদের মস্তিষ্ক এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র শেষ বছরগুলোতেও শক্তিশালীভাবে কাজ করতে পারে। যুক্তরাজ্যের লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেকানিক্সের অধ্যাপক ম্যাথিউ পেইন-এর মতে, বিজ্ঞানীরা সুস্থ বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের গোড়ালির ‘স্টার্টল রিফ্লেক্স’ (আকস্মিক শব্দে চমকে ওঠার প্রতিক্রিয়া) পরিমাপ করে এটি মূল্যায়ন করেছেন। ফলাফলে দেখা গেছে যে, শব্দে প্রতিক্রিয়া জানানোর এবং গোড়ালিতে ‘নড়াচড়া করো’ সংকেত পাঠানোর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অক্ষত থাকে।

তিনি বলেন, “সুস্থ বয়স্ক (মানুষদের) স্নায়ুতন্ত্রের কাঠামো খুব বেশি খারাপ হয় না। কেবল স্টার্টল রিফ্লেক্সের উপর ভিত্তি করেও তারা খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।”

এই দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে তিনি তুলনা করেছেন অলিম্পিকের দৌড়ে ‘ফলস স্টার্ট’ অর্থাৎ বাঁশি বাজার আগেই দৌড় শুরু করার সঙ্গে। তিনি বলেন, এতে বয়স্করা অযোগ্য ঘোষিত হতে পারে, তবে তারা জায়গা থেকে খুব দ্রুত বেশিদূর যেতে পারবেন না।”

রুলার টেস্টের পাশাপাশি, সাধারণ কম্পিউটার গেমের মাধ্যমেও প্রতিক্রিয়া সময় পরিমাপ করা যেতে পারে। এমন একটি পরীক্ষা ‘হিউম্যান বেঞ্চমার্ক রিঅ্যাকশন টাইম টেস্ট’। এই পরীক্ষায় একটি লাল বাক্স সবুজ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় এবং যত দ্রুত সম্ভব তাতে ক্লিক করতে হয়। সময়ের সাথে পারফরম্যান্সের উল্লেখযোগ্য অবনতি সংবেদনশীল সিস্টেমের দুর্বলতা এবং মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি ধীর হওয়ার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। গত বছর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্যাটার্ন দেখার এবং প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে দৃষ্টি সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হতে পারে, যা লক্ষণ শুরু হওয়ার এক দশকেরও বেশি আগে শুরু হয়।

কক্স বলেন, “বয়সের সাথে সাথে মস্তিষ্কের সাদা অংশে স্নায়ু তন্তুগুলো কম দক্ষতার সঙ্গে সংকেত আদান-প্রদান করতে শুরু করে, যার ফলে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের গতি ধীর হয়ে যায়। প্রতিক্রিয়া জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে, মস্তিষ্ক থেকে পেশীগুলোতে সংযোগকারী স্নায়ুগুলোকেও দ্রুত বার্তা প্রেরণের জন্য ভালো অবস্থায় থাকতে হয়, এবং এগুলোও বয়সের সঙ্গে দুর্বল হয়ে যায়।”

আপনার স্কোর উন্নত করুন

তবে এমন কিছু পদ্ধতি আছে যার মধ্য দিয়ে এই অবনতি ধীর বা প্রতিরোধ করা যায়। বায়োমেকানিক্সের অধ্যাপক ম্যাথিউ পেইন পেইন ‘ডুয়াল টাস্ক ট্রেনিং’য়ের পরামর্শ দেন, যার মধ্যে মস্তিষ্ক ও শরীর দুটিকেই ভালো রাখার জন্য একই সঙ্গে শারীরিক ব্যায়াম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, মাথা একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘোরানোর সময় হাঁটা, বর্ণমালা আবৃত্তি করার সময় এক পায়ে ভর দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা অথবা কাউন্ট করতে করতে বা ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ছন্দে বল শূন্যে ছুঁড়ে আবার ধরা। 

এমনকি টিভি স্ক্রিন বা ট্যাবলেটের মাধ্যমে ফিটনেস ক্লাসে অংশ নেওয়ার মতো জিনিসও আপনার প্রতিক্রিয়া সময় উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। পেইন বলেন, “এটি (একটি উদ্দীপনা) উপলব্ধি করার এবং অর্থপূর্ণ সমন্বিত নড়াচড়ার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা উন্নত করে।”

কক্স বলেন, স্বাস্থ্যকর বার্ধক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কার্যক্রম, যেমন পরবর্তী জীবনে খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া, অবসর সময়ে বাদ্যযন্ত্র শেখা বা বোর্ড গেমের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সাথে যুক্ত থাকা, এগুলো আমাদের ‘প্রতিক্রিয়া সময়ে’র ওপর ভালো প্রভাব ফেলতে পারে।

(বিবিসি অবলম্বনে)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত