প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরেও। আর এর ফলে তিন মাস না যেতেই ৭ বিলিয়ন (৭০০ কোটি) ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে দেশে। দিনে গড়ে এসেছে ১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার রেমিটেন্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৪ দিনে (১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরে) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ২২৩ কোটি ৪০ লাখ (২.২৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত বছরের সেপ্টেম্বরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২৪ দিনে ১৯০ কোটি ৯০ লাখ (১.৯০ বিলিয়ন) পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আর পুরো মাসে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪১ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের দুই মাস ২৪ দিনে (১ জুলাই থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর) প্রবাসীরা ৭১৩ কোটি (৭.১৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দুই মাস ২৪ দিনে ৬০৪ কোটি ৫০ লাখ (৬.০৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল দেশে।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে এখন ১২২ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে সেপ্টেম্বরের ২৪ দিনে ২৭ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনে গড়ে এসেছে ৯ কোটি ৩১ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ১ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা।
মাসের বাকি ৬ দিন (২৫ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) এই হারে এলে মাস শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ২৭৯ কোটি ২৫ লাখ (২.৭৯ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
একক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল গত মার্চ মাসে; রোজা ও ঈদ সামনে রেখে ওই মাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ৯৫ লাখ (২.৯৬ বিলিয়ন) ডলার আসে মে মাসে।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এখন রেমিটেন্সই সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে, যা সঙ্কটে পড়া অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ (২.৪৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে আসে ২৪২ কোটি ১৯ লাখ (২.৪২ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল ২০২৪ সালের আগস্টের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি।
দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি।
গত বছর প্রতি মাসে গড়ে রেমিটেন্স এসেছিল ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ (২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রেমিটেন্স এসেছিল ২ হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে আসে ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে আসে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার।
রিজার্ভ বাড়ছে
রেমিটেন্সের ওপর ভর করে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ কেটে গেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভ রয়েছে স্বস্তিদায়ক অবস্থায়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস বা মোট হিসাবে তা ছিল ৩০ দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার।
গত দুই সপ্তাহে সেই রিজার্ভ বেশ খানিকটা বেড়েছে। গত বুধবার দিন শেষে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ২৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে হয়েছে ৩১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।
আকুর দেনা শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।
আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের বিল শোধ করতে হবে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। তার আগে রিজার্ভ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
অর্থনীতির সামর্থ্য প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় থেকেই। অভ্যুত্থানের পর গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও উদ্বেগ কাটছিল না।
তবে বছর পার হওয়ার পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, রপ্তানি আয় এবং বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার বাজেট সহায়তার ঋণে রিজার্ভ স্বস্তির জায়গায় এসেছে।
সবশেষ গত জুলাই মাসের আমদানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তাতে দেখা যায় যে ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
সে হিসাবে বর্তমানের ২৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়।
আকু হলো এশিয়ার কয়েকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার নয়টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তার মূল্য প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি করা হয়।
আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। এর মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশগুলো থেকে বেশি পরিমাণে ডলার আয় করে। অন্যদিকে বেশিরভাগ দেশকেই আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় হিসাবে অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।