শুল্ক নিয়ে মন-কষাকষি ভারতকে সরিয়ে দিয়েছে দূরে, সেই ফাঁকে পাকিস্তানকে কাছে টানছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বৃহস্পতিবার তিনি হোয়াইট হাউসে আতিথ্য দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনিরকে; আলোচনা করেছেন আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে।
এই আলোচনার সময় ট্রাম্প তার সঙ্গে রেখেছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে, যা বৈঠকের গুরুত্বই তুলে ধরছে।
সোয়া ১ ঘণ্টার এই বৈঠক শুরুর ঠিক আগে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমাদের এখানে একজন মহান নেতা আসছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ফিল্ড মার্শাল।
“ফিল্ড মার্শাল খুবই মহান একজন ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীও তাই, দুজনেই। তারা আসছেন, এবং তারা হয়ত এই মুহূর্তে এই ঘরেই আছেন।”
পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রাম্পের এই গলাগলি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তার বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও আসেনি।
তবে দেশটির সংবাদমাধ্যম এই খবরটি ফলাও করে ছেপেছে যে হোয়াইট হাউসে ঢোকার পর শেহবাজ ও আসিফ মুনিরকে আধা ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ফেরার পরের মাসেই পুরনো বন্ধু হিসাবে হোয়াইট হাউসে আতিথ্য দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তাদের সেই বৈঠকে উষ্ণতার কমতি ছিল না।
কিন্তু এপ্রিলে ট্রাম্প বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পর নয়া দিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ এবং ভিসা ভি বাড়ানোর পর দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এখন বেশ শীতল।
বিপরীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলানোয় উদ্যোগী হতে দেখা যায় ট্রাম্পকে। বিরল নজির তৈরি করে গত জুন মাসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিফ মুনিরকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান তিনি।
তার তিন মাসের মধ্যে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ পেলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের প্রথম বৈঠক সেরে নিলেন তিনি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস দমনের মতো বিষয়গুলোতে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের ভূমিকায় প্রকাশ্য সমর্থনের জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান শেহবাজ। ট্রাম্পের প্রশংসা করতে গিয়ে তাকে ‘শান্তির কারিগর’ অভিহিত করেন তিনি।
কাশ্মিরের পগেহলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের যে যুদ্ধ বেঁধেছিল, চার দিনের মাথায় তা থামানোর কৃতিত্ব দাবি করেন ট্রাম্প। কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে ট্রাম্পের কোনও ভূমিকার কথা স্বীকার না করলেও বিপরীত অবস্থান পাকিস্তানের।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও শেহবাজ সেই প্রসঙ্গ তুলে যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার জন্য ট্রাম্পের উদ্যোগী ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, “তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করেছেন।”
মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়েও শেহবাজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ভূমিকার প্রশংসা করেন বলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়।
“গাজায় যুদ্ধ অবিলম্বে শেষ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন, বিশেষ করে এই সপ্তাহের শুরুতে নিউ ইয়র্কে মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে গাজা ও পশ্চিম তীরে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য একটি ব্যাপক মতবিনিময়ের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।”
ট্রাম্পের নেতৃত্বে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক আরও গাঢ় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেহবাজ। তিনি ট্রাম্পকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণও জানান।
বৈঠকের কয়েকটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে আন্তরিক পরিবেশের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়। একটি ছবিতে ট্রাম্পকেও হাসিমুখে তার ট্রেডমার্ক ‘থাম্বস-আপ’ দেখাতেও দেখা যায়।
পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছয় বছর পর ট্রাম্পের বৈঠক হলো। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সর্বশেষ ইমরান খান ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের দেখা পেয়েছিলেন।
এই বৈকের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডনকে বলেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সম্পর্ক ধীরে ধীরে উষ্ণ হচ্ছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে হবে না, এমনটাই জানান ওই কর্মকর্তা।
ট্রাম্পের দেখা পেতে অপেক্ষা
ভারতের এনডিটিভি জানিয়েছে, হোয়াইট হাউসে ঢোকার পর ট্রাম্পের দেখা পেতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
তাদের প্রতিবেদনের বর্ণনা অনুসারে, শেহবাজ ও মুনির বিকাল ৪টা ৫২ মিনিটে হোয়াইট হাউসে পৌঁছান। তাদের স্বাগত জানান হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা।
তখন ট্রাম্প বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখনই ট্রাম্প বলেছিলেন, হোয়াইট হাউসে ‘মহান নেতারা’ আসছেন।
হোয়াইট হাউসের প্রেস পুলের ছবিগুলোতেও দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় শেহবাজ ও মুনির অপেক্ষা করছেন।
এই অপেক্ষাটি আধা ঘণ্টা সময়ের জন্য ছিল বলে ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআইকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে এনডিটিভি।
পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর সন্ধ্যা ৬টা ১৮ মিনিটে হোয়িইট হাউস থেকে বের হয়। তার মধ্যে তারা বৈঠক ও ভোজ সারেন।
পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডন জানিয়েছে, বৈঠকটি ওয়াশিংটনের সময় বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলায় প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়।
ডন জানায়, ওভাল অফিসে শেহবাজ ও মুনির অপেক্ষা করার সময় সেই ঘরেরই অন্য প্রান্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার কাজ শেষ করছিলেন।
সংবাদকর্মীরা যখন তাদের সরঞ্জাম গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন আসিম মুনিরকে কথা বলতে দেখা যায় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও ওভাল অফিসে ঢুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান শেহবাজ ও মুনিরকে।
ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানে বৈঠকটি ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট চলে। তবে এই বৈঠকে কোনও সাংবাদিকদের রাখা হয়নি।
তথ্যসূত্র : ডন, এনডিটিভি