২০১৬ এসএ গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন সেনাবাহিনীর সাঁতারু রুমানা আক্তার। সেটাই ছিল তার প্রথম বড় কোন সাঁতার ইভেন্ট। ২০১৯ এসএ গেমস ভালো কাটেনি। ২০২১ এ মা হয়েছেন, এরপর ২০২২ এ সেনাবাহিনীর হয়ে মিশনে যাওয়ায় সাঁতার থেকে দূরে সরে যান। গত বছর আবার পুলে ফিরে জাতীয় রেকর্ড গড়েছেন প্রিয় ব্রেস্ট স্ট্রোকে। সম্প্রতি শেষ হওয়া জাতীয় সাঁতারে একই প্রতিযোগীতায় নিজের টাইমিংয়ে উন্নতি করেছেন। তিনটি জাতীয় রেকর্ড গড়ে জিতেছেন ৫টি স্বর্ণ। তবুও আক্ষেপ রুমানার, ভালো করেও অলিম্পিকের মতো বড় ইভেন্টে নাম আসেনা তার। সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন রুমানা।
প্রশ্ন : রেকর্ড গড়ার পর আপনার সন্তান আপনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই মুহুর্তটা আপনি কীভাবে উপভোগ করেছেন?
রুমানা : অবশ্যই অনেক ভালো লেগেছে। ও যে এরকম ভাবে হঠাৎ করে পানিতে ঝঁপিয়ে পড়বে, এমনটা আশা করি নাই। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে সে পানিতে পড়ে গেল নাকি! তাই আমি তাড়াতাড়ি ওর দিকে যাই। দেখলাম ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে – আম্মু তুমি ফার্স্ট হইছো, ফার্স্ট হইছো! আমিও বললাম – হ্যাঁ, আম্মু আমি ফার্স্ট হইছি। এই মুহুর্তটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।
প্রশ্ন : আপনি সাঁতার থেকে অনেকটা দূরে ছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হয়ে মিশনে গেছেন, লম্বা বিরতিতে অ্যাথলেটদের ফিটনেস কমে যায়। আবার সেরা হয়ে ফিরলেন কীভাবে?
রুমানা : তা-তো অবশ্যই। এরকম বিরতিগুলো একজন অ্যাথলেটকে ফিটনেসের দিক থেকে পিছিয়ে দেয়। আমি ২০২৩ সালে মিশন থেকে ফিরি। ২০২৪ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একটা ইভেন্টে অংশ নেই। এবার যেমন অনেকগুলো ইভেন্টে অংশ নিলাম এরকম মিশনে যাওয়ার আগেও ৬-৭টা ইভেন্টে অংশ নিতাম। কিন্তু ২০২৪ সালে আমার সেরা ইভেন্ট যেটা ব্রেস্ট স্ট্রোক ওটাতেই অংশ নিই। কারণ এতদিন পর আসছি, সব ইভেন্ট করলে হয়তো কিছু জিততে পারব না। তাই চিন্তা করলাম একটাতে ফোকাস করি যেটাতে আমি স্বর্ণ পদক জিততে পারব। কারণ আমি এতদিন তো পুলে নেমেছি আর স্বর্ণ জিতে উঠে আসছি সেই ধারাবাহিকতাটা যেন থাকে। গতবারই ১০০ ও ২০০ মিটারে দুটোতেই স্বর্ণ জিতেছিলাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সেবারই (২০২৪) আমি ১০০ মিটারে নিজের সেরা টাইমিং করি। সেটা ১.১৮.২৭ সেকেন্ডের।

প্রশ্ন : এবার যে বেশ কিছু ইভেন্টে অংশ নিলেন…
রুমানা : হ্যাঁ, গত বছর ভালো করায় আমি চিন্তা করলাম আগে যেসব ইভেন্টে অংশ নিতাম সেগুলোতে ফিরে যাই। আর এবার মিশরীয় কোচ সাইদ মাগদি যিনি অনুশীলন করাচ্ছেন তার অধীনে বেশ ভালো মানের প্রস্তুতি নিতে পেরেছি। এজন্য সবগুলো ইভেন্টে আমি সহজে মানিয়ে নিতে পেরেছি। কেমন করেছি সেটা তো ফলাফলই বলে দিচ্ছে। মোট ৩টি জাতীয় রেকর্ড গড়ে ৫টি স্বর্ণ ও ৩টি রৌপ্য জিতেছি।
প্রশ্ন : আপনি যখন মিশনে ছিলেন তখন নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত রেখেছিলেন?
রুমানা : আমি সেনাবাহিনীতে করপোরাল পদে আছি। সুদানে মিশনে ছিলাম ১৮ মাস, ২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সেখানে সাঁতারের জন্য আলাদা কোন প্রস্তুতিই নিতে পারিনি। মিশনের ব্যস্ততাই বেশি ছিল। তবে একটা জিনিস ছিল যে সকালে আমাদের যে পিটি প্যারেড থাকতো তাতে আমি পুরোপুরি মনযোগী থাকতাম। নিজেকে ফিট রাখার জন্য আমি ওইটুকু সময় অনুশীলনে কাজে লাগিয়েছি। ২০২৪ সালে এসে আমি সাঁতারের প্রস্তুতি বা অনুশীলনগুলো শুরু করি।
প্রশ্ন : মিশনে যাওয়ার আগে আপনি কোন সাল পর্যন্ত সাঁতারে নিয়মিত ছিলেন বা কোন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন?
রুমানা : মিশনের আগে সর্বশেষ ২০১৯ সালে সাফ গেমসে অংশ নেই। দুর্ভাগ্যবশত সেখানে কোন পদক জিততে পারিনি। কিন্তু ২০১৬ সাফ গেমসে ২০০ মি. ব্রেস্ট স্ট্রোকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম। সেটা আমার প্রথম কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছিল। এরপর ২০২০ সালে আমার বিয়ে হয়, ২০২১ সালে আমার সন্তান হয় এবং ২০২২ সালে মিশনে যাই।

প্রশ্ন : এবার এসএ গেমস হবে কিনা সেটা নিয়ে একটা শঙ্কা আছে। তবে এই যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো করলেন এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য কি লক্ষ্য ঠিক করছেন?
রুমানা : আমাদের এই যে ক্যাম্প বা প্রস্তুতি সেটা তো এসএ গেমসের জন্যই। সেক্ষেত্রে আমরা বিদেশি কোচ পেলাম, ওনার অনুশীলন পদ্ধতি বেশ ভালো। এর মাঝে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ হলো। সেখানে প্রতিটা সাঁতারুর কিন্তু টাইমিংয়ে উন্নতি হয়েছে। প্রতিদিনই আপনারা জাতীয় রেকর্ড দেখেছেন। এখন সাফ গেমস হবে কিনা সেটা পরের বিষয় কিন্তু আমরা নিজেদের এই উন্নতি ধরে রাখার জন্য ক্যাম্প করে যাবো।
প্রশ্ন : আপনারা এই যে অনুশীলন করে যাচ্ছেন। এখানে বাংলাদেশের মেয়ে সাঁতারুরা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ভালো করলেও অলিম্পিকে বা এসএ গেমসের উপরে কেন যেতে পারছেন না? ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কোন দিক দিয়ে পিছিয়ে?
রুমানা : আসলে এটা নিয়ে কিছু বলার নেই, মেয়েদেরকে হয়তো সেভাবে দেখে না। আমরা মেয়েরা কি ভালো করি না!গত বছর এত বিরতির পর, একজন অ্যাথলেট মা হওয়ার পর তার কাছ থেকে কেউ কিছু আশা করে না। এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব দেখা যায়। সেক্ষেত্রে আমি টাইমিং কমিয়েও রেকর্ড করলাম তারপরও ফেডারেশন থেকে আলাদা নজর দেওয়া হয় না।
আমি ২০১২ থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে আসছি। আমি কখনই ফেডারেশনের নজরে আসতে পারিনি। ভালো করেও সুনজর পাইনি। আর এখন তো কতদিন খেলতে পারব জানি না, পারফরম্যান্স কতদিন থাকবে তাও জানি না। আমার বাচ্চা আমার কাছে থাকে না, তাকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে সাঁতারে সময় দিচ্ছি, টাইমিংয়ে উন্নতি করছি, তবুও আমি ভালো পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হই না। কষ্ট হয় যে সাঁতারের জন্য, দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য এই যে সময় দিচ্ছি সেটার বিনিময়ে কি পাচ্ছি? সবাই সামনা-সামনি বলে কীভাবে এখনও এত ভালো টাইমিং করলে, কিন্তু সুবিধা দেওয়ার সময় আর দেখে না আমাকে।

প্রশ্ন : এতদিন যে সাঁতারের বাইরে থাকলেন, কখনও কি মনে হয় নাই যে আর ফিরতে পারবো না?
রুমানা : পুলে ফিরবো না— এটা কখনো মনে হয়নি। আমি ভেবেছিলাম যেভাবে দূরে সরে গেছি হয়তো ভালো করতে পারবো না। কিন্তু সাঁতারটা এমন ভাবে রক্তে মিশে গেছে যে আবার যখন ২০২৪ এর জন্য প্রস্তুতি নেই তখন নিজেকে সেরা অবস্থানে ফিরে পাই।
প্রশ্ন : সামনে যদি কোন টুর্নামেন্ট থাকে তাহলে কি চাইবেন ?
রুমানা : কি আর চাইবো! অন্যান্য সময় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে যারা ভালো করে তাদের থেকে বাছাই করা হয়। কিন্তু এবার তা করে নাই। তিন মাস আগে ওপেন ট্রায়াল করিয়েছে। আর ওপেন ট্রায়াল এমন ভাবে করানো হয়, দেখা গেল একটা ছুটির পর হঠাৎ বলা হয় আগামীকাল ট্রায়াল। এত কম সময়ে, কোন অনুশীলন ছাড়া, প্রস্তুতি ছাড়া হিটে নেমে যেতে হয়। তারপরও হিটে প্রথম হই আমি, তাও আমাকে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের জন্য শুধু না, আমরা যারা জাতীয়তে ভালো করি আমাদেরও তো বড় ইভেন্টে খেলার ইচ্ছা আছে। আমরা শুধু সাফ গেমসের দিকেই তাকিয়ে থাকি। এখনও এই অবস্থাই চলছে।



