একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে এখন সব মিলিয়ে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে বলে হিসাব দিয়েছে বিজিএমইএ।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ এই সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, “আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এমএফএন (মোস্ট ফেডারড নেশন) শুল্ক দিতাম। এখন যে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে, এর ফলে আমাদের মোট শুল্কের হার দাঁড়াল গড়ে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা সুনির্দিষ্টভাবে বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন হারে প্রযোজ্য হবে।”
তিনি আরও বলেছেন, “আমাদের মার্কিন রপ্তানির প্রায় ৭৫ শতাংশ হচ্ছে তুলাভিত্তিক পোশাক। শুল্কসংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে বলা আছে, যদি ন্যূনতম ২০ শতাংশ আমেরিকার কাঁচামাল (যেমন তুলা) ব্যবহার করা হয়, তাহলে আমেরিকার কাঁচামালের মূল্যের ওপর এই অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ আমেরিকার কাঁচামাল ব্যবহার করলে আমরা বাড়তি কিছু শুল্ক ছাড় পাব।”
শনিবার রাজধানী ঢাকার উত্তরায় বিজিএমইএ সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূরক শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশের জন্য ‘আত্মতুষ্টির’ সুযোগ দেখছেন না মাহমুদ হাসান খান।
তিনি বলেছেন, “আমাদের আত্মতুষ্টির কোনও সুযোগ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নির্বাহী আদেশে স্পষ্ট বলা আছে, কিছু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বা নিরাপত্তা চুক্তি আলোচনা এখনও চলমান রয়েছে। চুক্তিগুলো হয়ে গেলে এসব দেশের পণ্যে শুল্ক আরও কমে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশকেও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।”
ওয়াশিংটনে ধারাবাহিক আলোচনার পর বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দপ্তর থেকে বাংলাদেশের পণ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ধার্যের ঘোষণা দেওয়া হয়। শুল্কভার কমিয়ে আনাকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আলোচনায় সাফল্য হিসাবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চেয়ারে ফেরার পরপরই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বড় অঙ্কের পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন।
গত ২ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। তাতে দেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য দেশটিতে শুল্কভার ৫২ শতাংশে উঠে গিয়েছিল।
কয়েকদিন পরে ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর আরোপিত ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। দেশগুলোকে এ সময় দেওয়া হয় বাণিজ্য আলোচনায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের জন্য সুবিধা বাড়াতে।
তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হওয়ার ঠিক আগে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত জানান।
এই শুল্কের হার কমাতেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেওয়া হয়।
ওই চিঠি পাওয়ার পরপরই একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দল নিয়ে ওয়াশিংটনে যান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশীরউদ্দিন। ইউএসটিআরের সঙ্গে এক দফা আলোচনা সেরে দেশে ফেরার পর গত ২৮ জুলাই তিনি ফের যান ওয়াশিংটনে। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
সরকারি প্রতিনিধিদলের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের একটি দলও যুক্তরাষ্ট্র গেছে। ব্যবসায়ীদের এ দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির আলাদা বৈঠক হওয়ার কথা। সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) সই হওয়ার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার ছিল সরকারি প্রতিনিধি দলের তৃতীয় দিনের আলোচনা, যা রাত ১টায় শেষ হয়। এর পরপরই হোয়াইট হাউস বাংলাদেশসহ আরও বেশ কিছু দেশের শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধন রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। এই বাজারে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ওপর শুল্কও ২০ শতাংশ আরোপ করেছেন ট্রাম্প। আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বোডিয়ার ওপর শুল্ক বসেছে ১৯ শতাংশ। ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে।
ফলে শুল্কহারের বিচারে পোশাক পণ্য রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কারও কাছ থেকে হুমকিতে পড়তে হচ্ছে না বাংলাদেশকে।
একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫০ কোটি (২.৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। অন্যদিকে এই অর্থ বছরে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ২৩ লাখ (৮.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে দেশটির উড়োজাহাজ কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। মূলত পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষির অংশ হিসেবে বিমান কেনার এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), সয়াবিন তেল ও তুলা কেনার পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাসের বিষয়ে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “প্রথমেই আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, তারা একটি ভারসাম্যপূর্ণ শুল্ক কাঠামো ঘোষণা করেছে, যেটি বিগত প্রায় ৪ মাস যাবৎ আমাদের আমাদের উদ্বেগের কারণ ছিল।
“বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক ৩৫% থেকে কমিয়ে ২০% পুননির্ধারণ করা হয়েছে, যা আমাদের প্রধান পোশাক রপ্তানিকারী প্রতিযোগীদের তুলনায় সমান বা কাছাকাছি, এবং কিছু প্রধান প্রতিযোগী যেমন চীন (৩০%) ও ভারতের (২৫%) তুলনায় কম।”
তিনি বলেন, “আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে বলতে চাই আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিশেষ করে বাণিজ্য উপদেষ্টা, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও তাদের টিম এই কঠিন আলোচনার সময় যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তার প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ একটি সমূহ বিপর্যয় এড়াতে পেরেছে।”
তবে এই ফলাফল একদিনে আসেনি, যাত্রাটি ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের মন্তব্য করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “২ এপ্রিল যখন যুক্তরাষ্ট্র ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’ নামে নতুন শুল্ক ঘোষণা করল, তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭% ধার্য করা হয়। তখন ভারতের ওপর ২৬%, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২% ও পাকিস্তানের ওপর ৩০% শুল্ক আরোপ করা হলো।
“এটা আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কারণ এতো বড় শুল্ক ব্যবধানে বাজার ধরে রাখা সম্ভব নয়। আমাদের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০% আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, আর দেশটিতে আমাদের মোট রপ্তানির ৮৭% হয় তৈরি পোশাক পণ্য।”
মাহমুদ হাসান খান বলেন, “বিগত দশকে কর্মক্ষত্রে নিরাপত্তা ও সামাজিক-পরিবেশগত সকল বিষয়ে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমাদের এই সক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, নতুন ডিজাইন ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে, বাজার ও পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে।
“যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শুধু সবচেয়ে বড় বাজার না, তারা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য অংশীদার। এই অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর, এবং আমরা আশা করি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার যত্নশীল থাকবে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ২০% পাল্টা শুল্ক অবধারিতভাবে আমাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়াবে, যেখানে শিল্পগুলো আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেটাতে প্রাণান্তকরভাবে যুদ্ধ করছে। এক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
বিজিএমই সভাপতি বলেন, “বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো যাতে করে ব্যবসা থেকে ছিটকে না পড়ে, তা সরকারকে নজরদারিতে রাখতে হবে। আমরা একান্তভাবে আশা করি, শিল্প ও দেশের স্বার্থে সরকারের সকল নীতি সহায়তা চলমান থাকবে, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে কাস্টমস সংক্রান্ত নীতিগুলো শিল্পবান্ধব হবে, চট্রগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্প নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ পাবে।”
তিনি বলেন, “বিজিএমইএ থেকে আমরা আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। আমরা তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ, স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতামত এবং বোর্ড সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে কাজ করব।”
“আমরা মনে করি, শিল্প মালিক, সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজ—সবাই মিলে একসাথে কাজ করে শিল্পের জন্য যদি সম্মিলিতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তাহলে এই শুল্ক প্রতিবন্ধকতা না হয়ে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে,” বলেন মাহমুদ হাসান খান।