Beta
মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৫

ট্রাম্প শুল্কের ধাক্কা রপ্তানি আয়ে, ৫ মাসে সবচেয়ে কম সেপ্টেম্বরে

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দর।
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দর।
[publishpress_authors_box]

আগস্টের পর সেপ্টেম্বর মাসেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৬২ কোটি ৭৫ লাখ (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই আয় পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। এই মাসে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

গত এপ্রিলে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩০১ কোটি ৬৬ লাখ (৩.০১ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরের আয়ের অঙ্ক ছিল ৩৮০ কোটি ২৮ লাখ (৩.৮০ বিলিয়ন) ডলার।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে অস্থিরতার কারণেই রপ্তানি আয় কমছে। আগামী মাসগুলোতেও এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন তারা।

রপ্তানি আয়ে বড় উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৫-২৬ অর্থ বছর; অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৭৭ কোটি (৪.৭৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়, যা ছিল গত অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি।

কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেই হোঁচট খায়। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৯১ কোটি ৫০ লাখ (৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল। গত অর্থ বছরের আগস্ট মাসের চেয়ে কমেছিল ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রবিবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৬২ কোটি ৭৫ লাখ (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে। গত ২০২৪-২৫ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে আয়ের অঙ্ক ছিল ৩৮০ কোটি ২৮ লাখ (৩.৮০ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই সেপ্টেম্বরে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।

অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স। গত অর্থ বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থ বছরেও এই দুই সূচকে ঊর্ধ্বমুখী ধারা নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থ বছর শুরু হয়েছিল।

এই আর্থিক বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স বেড়েছিল ২৯ দশমিক ৫০ শতাংশ; দ্বিতীয় মাস আগস্টে বাড়ে ৯ শতাংশ। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ।

কিন্তু রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় থাকলেও রপ্তানি আয় কমছেই।

গত এপ্রিল থেকে ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে একধরনের অস্থিরতা ছিল। ৩১ জুলাই বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পাল্টা শুল্ক এড়াতে জুলাই মাসে অনেক পণ্য জাহাজীকরণ হয়েছে। স্থগিত থাকা অনেক পণ্যও রপ্তানি হয়। সে কারণে জুলাই মাসে রপ্তানি অনেক বেড়েছিল বলে মনে করেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।

৭ আগস্ট থেকে ট্রাম্প শুল্ক কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশে। পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জন্য শুল্ক ঘোষণা করেন। তাতে বাংলাদেশের শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমে হয় ২০ শতাংশ।

প্রতিযোগী দেশের তুলনায় পাল্টা শুল্ক কাছাকাছি হওয়ায় দুশ্চিন্তামুক্ত হন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। একই সঙ্গে চীনের পণ্যে ৩০ ও ভারতে মোট ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই বাড়তি ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করেছে।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ধাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক রপ্তানি আয়েও প্রতিফলিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “তৈরি পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে, কারণ বেশিরভাগ ক্রেতাই নতুন করে কোনও অর্ডার দিচ্ছে না। তারা এখন অতিরিক্ত ২০ শতাংশ রেসিপ্রোক‍্যাল শুল্কের (পাল্টা শুল্ক) একটি অংশ বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

“রপ্তানিকারকদের পক্ষে এই অতিরিক্ত চাপ বহন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, কারণ তারা ইতোমধ্যেই প্রাথমিক শুল্ক সমন্বয় এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাবসহ বিভিন্ন ধরনের চাপে রয়েছে।”

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এছাড়া, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যান্য বাজারেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে, কারণ চীনা ও ভারতীয় প্রস্তুতকারকরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এইসব বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

“আমরা আশঙ্কা করছি, এই ধীরগতি আগামী দুই থেকে তিন মাস অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে, আমাদের রপ্তানি আবারও পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করছি।”

“এ সময়টায় রপ্তানিকারকদের ধৈর্য সহকারে ক্রেতাদের যেকোনো ধরনের চাপ মোকাবেলা করতে হবে,” বলেন মোহাম্মদ হাতেম।

তবে চলতি অর্থ বছরের তিন মাসের (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) হিসাবে এখনও প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। মূলত প্রথম মাস জুলাইয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণেই প্রবৃদ্ধি রয়ে গেছে।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য রপ্তানি থেকে সব সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৩১ কোটি ৩২ লাখ (১২.৩১ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আয়ের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ১৬৫ কোটি ৫৫ লাখ (১১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার।

মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় কমার কারণেই আগস্টের পর সেপ্টেম্বরেও রপ্তানি আয় ধাক্কা খেয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে ২৮৩ কোটি ৯৭ লাখ (২.৮৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩০১ কোটি (৩.০১ বিলিয়ন) ডলার।

এ হিসাবেই সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৮২৮ কোটি ৩৯ লাখ (৪৮.২৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

এর মধ্যে শেষ মাস জুনে ৩৩৩ কোটি ৭৯ লাখ (৩.৩৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এপ্রিল মাসে আয়ের অঙ্ক ছিল ৩০০ কোটি (৩ বিলিয়ন) ডলার। মার্চে আয় হয়েছিল ৪২৪ কোটি ৮৬ লাখ (৪.২৫ বিলিয়ন) ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আয়ের অঙ্ক ছিল ৩৯৭ কোটি ৩১ লাখ ডলার।

২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৪৪৩ কোটি ৬০ লাখ (৪.৪৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন রপ্তানিকারকরা। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল ৪৬২ কোটি ৭৫ লাখ (৪.৬২ বিলিয়ন) ডলার।

নভেম্বর মাসে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৪১১ কোটি ৯৭ লাখ (৪.১২ বিলিয়ন) ডলার; অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার; আগস্ট ও জুলাইয়ে আয়ের অঙ্ক ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক শূন্য তিন ও ৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে। গত বছরের জুলাই মাসে রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইপিবি।

এরপর থেকে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত বা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে ইপিবি। গরমিল ধরা পরার পর গত বছরের ৯ অক্টোবর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের তিন মাসের (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করে ইপিবি। এরপর প্রতি মাসেই রপ্তানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে, যা প্রকৃত তথ্য বলে দাবি করছে ইপিবি।

৭৮.২৮ শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি করে ২৮৩ কোটি ৯৭ লাখ (২.৮৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে মোট রপ্তানি আয়ের ৭৮ দশমিক ২৮ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

সেপ্টেম্বরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার; গত বছরের আগস্টের চেয়ে যা ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম। আর ওভেন পোশাক থেকে আয় কমেছে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আয় এসেছে ১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার।

অন্যান্য খাত

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ১০ কোটি ৪৪ লাখ ডলার আয় হয়েছে। কমেছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৯ কোটি ১ লাখ ডলার; বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

তবে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে দশমিক ৫৪ শতাংশ; এসেছে ৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

২০২৩-২৪ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থ বছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছিল অন্তর্বর্তী সরকার।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি (৫৫ বিলিয়ন) ডলার।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত