Beta
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

ট্রাম্প শুল্ক : কেন দরিদ্রদের ওপর চড়া, ধনীদের কেন রেহাই

tariff trump
[publishpress_authors_box]

দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করেছেন শুল্কযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে তার শুল্ক আরোপের নীতি সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে দরিদ্র দেশগুলোকে। অথচ ওই দেশগুলোকে সাহায্যের জন্যই মূলত বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল।

দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলো অনেক দরিদ্র দেশকে বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা দিয়ে এসেছে। এসব সুবিধার মধ্যে শুল্ক কমানো ও বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাতে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এগিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন হাঁটছে ভিন্ন পথে।

এই প্রশাসন বিশ্বের ধনী দেশগুলোর পণ্যে, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। অথচ ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরাকের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পণ্যে ২০ বা তারও বেশি শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে।

এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দুই দেশ, মিয়ানমার ও লাওস পেয়েছে ৪০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসবাবপত্র ও পোশাকের মতো পণ্য তাদের রপ্তানি প্রায় ধ্বংসের মুখে।

ট্রাম্প গত বুধবার ঘোষণা দেন, ভারত থেকে আমদানিতে শুল্ক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হবে। ওয়াশিংটন ও নয়া দিল্লির মধ্যে এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল রাশিয়ার তেল আমদানির ইস্যুতে দ্বন্দ্ব।

নতুন সরাসরি বাণিজ্য আলোচনার যুগে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ অর্থনীতির বিপরীতে এই দরিদ্র দেশগুলোর দর-কষাকষির ক্ষমতা সবচেয়ে কম।

কম মজুরি কিছু দেশকে যেমন বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামকে উৎপাদনশীলতার দিক থেকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু এসব দেশের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়বহুল পণ্য কিনতে সক্ষম নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বড় ধরনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে, যা ট্রাম্পের বিরক্তির কারণ।

এছাড়া ট্রাম্প চান বাণিজ্য অংশীদাররা যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করুক। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো ধনী দেশগুলোর মতো শত শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার সামর্থ্য রাখে না, যা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

কিছু দেশ যাদের ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশি, তারা এই কড়া শুল্ক থেকে রেহাই পেয়েছে। যেমন সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশের বেশি হয়নি। এই দেশগুলো তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক। আর তাদের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

হেইনরিক ফাউন্ডেশনের এশিয়াভিত্তিক বাণিজ্যনীতি প্রধান ডেবোরা এলমস বলেন, “এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত উচ্চ শুল্কের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এটি বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় পরিবর্তন।”

২০২০ সাল পর্যন্ত অনেক দরিদ্র দেশ যেমন কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) নামে একটি বিশেষ ব্যবস্থার সুবিধা পেত। এর আওতায় বিশ্বের শতাধিক দরিদ্র দেশ ও অঞ্চলের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক মওকুফ ছিল। এই ব্যবস্থা নবায়ন করা হয়নি। ফলে দরিদ্র দেশগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার আরও সীমিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে কম্বোডিয়াকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। ছোট এই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের বড় রপ্তানিকারক। সেখানে ১৯ শতাংশ শুল্ক আরোপে দেশটির পোশাক শিল্পে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী সান চানথল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা একটি দরিদ্র দেশ। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা ধনী দেশের মতো নয়।”

কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির শুল্ক শূন্যে নামিয়ে এনেছে। তাদের জাতীয় বিমান সংস্থা বোয়িং থেকে ১০টি বিমান কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া আরও ১০টি কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এটি জাপানের মতো ধনী দেশের আর্থিক প্রতিশ্রুতির তুলনায় নগণ্য। কারণ জাপান বোয়িং থেকে ১০০টি বিমান কেনার চুক্তি করেছে।

যদিও ১৯ শতাংশ শুল্ক কিছু উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় সামান্য ভালো। তবুও কম্বোডিয়া সরকার আরও কম শুল্কের আশা করেছিল।

সান চানথল বলেন, “আমি অন্তত ১৫ শতাংশ শুল্ক আশা করেছিলাম, যেমন কোরিয়া বা জাপানের ক্ষেত্রে হয়েছে।”

এখন কম্বোডিয়ার কোম্পানিগুলো আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে বেশি শুল্ক তাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম টিনজাত আনারস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পিটি গ্রেট জায়ান্ট পাইনঅ্যাপলের নির্বাহী বার্নহার্ড ভেভেংকাং আশা করছেন, ১৯ শতাংশ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সবচেয়ে বড় বাজার।

তিনি চান অন্য বাজারে আরও বেশি আনারস বিক্রি করতে। কিন্তু শিল্পের অন্যান্য কোম্পানিও একই পরিকল্পনা করছে।

গ্রেট জায়ান্ট পাইনঅ্যাপলের লাভের পরিমাণ এত কম যে তারা দাম কমাতে পারবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা বেশি খরচের মুখে পড়বে, যা তারা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। এতে টিনজাত আনারসের বিক্রি কমে গিয়ে কোম্পানির আয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

শুল্ক সম্পর্কে বার্নহার্ড ভেভেংকাং বলেন, “এটা অনেক।”

অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য কর্মকর্তারা প্রায়ই বিভ্রান্ত হন, কেন কিছু দেশ উচ্চ শুল্ক এড়িয়ে যেতে পারে, আর কিছু দেশ কঠোরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।

আলজেরিয়া ও লিবিয়ার পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ইরাকের পণ্যে শুল্ক ৩৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি শুল্কের মধ্যে রয়েছে সিরিয়ার পণ্যে আরোপিত ৪১ শতাংশ শুল্ক। দীর্ঘদিন কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা সিরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে খুব অল্প পণ্য রপ্তানি করে। তবুও তাদের শুল্ক হার সুইজারল্যান্ডের চেয়েও বেশি, যেখানে ধনী এই দেশটির পণ্যে ৩৯ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। ধনী দেশগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ডের শুল্কহার সবচেয়ে বেশি।

ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো হোয়াইট হাউসের নজরে এসেছে চীনের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে। আবার কখনও ট্রাম্প তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ, তিনি ব্রাজিলের কিছু পণ্যে, যেমন কফিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন সাবেক ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া আইনি পদক্ষেপের ঘটনাকে।

গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার পণ্যে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তারা মাসের পর মাস শুল্ক কমানোর জন্য চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা গত মে মাসে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। এই সম্পর্কের অবনতির পেছনে ছিল বর্ণ বৈষম্য, ইসরায়েল ইস্যু ও বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব।

কিন্তু হোয়াইট হাউসের এই বৈঠক পরে পরিণত হয় তীব্র বাকবিতণ্ডায়। বিষয় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের প্রতি কথিত হুমকি।

দক্ষিণ আফ্রিকার রপ্তানি পণ্যের মধ্যে মূলত প্লাটিনাম ও গাড়ি রয়েছে। তবে দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, অনেক রপ্তানি পণ্য বিশেষ করে সাইট্রাস ফল যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদকদের জন্য হুমকি নয়। কারণ এসব ফল মৌসুমি ফাঁক পূরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত পণ্যকে প্রতিস্থাপন করে না।

দক্ষিণ আফ্রিকার সাইট্রাস গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, লক্ষাধিক কার্টন সাইট্রাস ফল ইতোমধ্যে প্যাক করা হয়েছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তারা সতর্ক করেছে, ৩০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে এই ফলের বেশিরভাগই বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত