মনের খোরাক জোগাতেই সিনেমা। সেই সিনেমাই যখন মনের অসুখ বয়ে আনে তখন সেটি সত্যি দুঃখজনক। সিনেমা দেখে যেমন দর্শক মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে পারেন, তেমনি এতে অভিনয়কারীদের ঘোরের জগতে চলে গিয়ে মনোরোগে আক্রান্ত হওয়ার উদাহরণ বিরল নয়।
চলচ্চিত্রে অভিনয়কারীদের মানসিক রোগ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কোনও একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তুতির জন্য বা অভিনয়ের পর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নানা ধরনের মানসিক রোগে ভোগেন। চলচ্চিত্র জগতে তারকার আত্মহত্যার ঘটনার খবর হরহামশোই পাওয়া যায়। রঙিন পর্দার বাইরে অভিনয়শিল্পীদের একাকিত্ব ও বিষণ্ণতার খোঁজ কজনই বা রাখেন!
১. রোল ইমারশন সিনড্রোম বা চরিত্র-আবেশজনিত মানসিক চাপ
কোনও গভীর, ট্র্যাজিক বা বিকৃত চরিত্রে দীর্ঘদিন অভিনয় করার ফলে এমনও দেখা অভিনয় শিল্পী বাস্তব জীবনেও চরিত্রটির আবেশে ডুবে যান। উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা হিথ লেজার এর কথা বলা যেতে পারে।
১৯৭৯ সালে জন্ম নেওয়া অভিনয় জীবন শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। পরে অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে, এবং পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে হলিউডে পা রাখেন।
হিথ লেজার বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন তার বৈচিত্র্যময় এবং গভীর অভিনয়ের জন্য। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘টেন থিংস আই হেট অ্যাবাউট ইউ’ (১৯৯৯), ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ (২০০০), ‘আ নাইটস টেল’ (২০০১), ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’ (২০০৫), এবং ‘দ্য ডার্ক নাইট’ (২০০৮)। বিশেষ করে “দ্য ডার্ক নাইট” চলচ্চিত্রে তিনি ‘দ্য জোকার’ চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন। এ অথচ এই চরিত্রটি তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ‘জোকার’ চরিত্রে এই অভিনেতা এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন যে অবসাদ, ঘুমহীনতা ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করেন। পরে অতিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ সেবনের ফলে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তার অকাল মৃত্যু হয়।
প্রায় একইরকম একটি উদাহরণ রয়েছে ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ মার্কিন অভিনেতা অ্যাড্রিয়ান ব্রোডির জীবনেও। নাৎসি আগ্রাসনের সময়কার এক দুঃখী পিয়ানিস্টের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ব্রোডি বাস্তব জীবনের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করেন, ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেন, একাকি জীবন বেছে নেন। দীর্ঘদিন হতাশায় ভুগেছিলেন। পরে অবশ্য তিনি ফিরে আসতে পেরেছিলেন।
২. চলচ্চিত্র-পরবর্তী বিষণ্ণতা
একটি বড় প্রকল্প বা দীর্ঘ শুটিং পর্ব শেষ হওয়ার পরে হঠাৎ করে শূন্যতা ও হতাশা তৈরি হতে পারে এর কলাকুশলীদের মধ্যে।
‘হারি পটার’ সিরিজ শেষ হওয়ার পর এমা ওয়াটসন দীর্ঘ সময় বিষণ্ণতায় ভুগেছিলেন। হঠাৎ করে পরিচিত চরিত্র ও শুটিং থেকে আলাদা হওয়াটা মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার।
হ্যারি পটার চরিত্রে অভিনয়কারী ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ নিজেও বলেছেন যে, দীর্ঘ শুটিং জীবন শেষে হঠাৎ করে বাস্তব জীবনে ফিরে আসা ছিল মানসিকভাবে কঠিন।
৩. মেথড অ্যাকটিং স্ট্রস ডিজঅর্ডার
‘মেথড অ্যাক্টিং’ মানে চরিত্রে ঢুকে যাওয়া, চরিত্রের মতো জীবনযাপন করা। এটি অনেক সময় মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
জোকার সিনেমায় মূল ভূমিকায় অভিনয়কারী ৫৩ বছর বয়সী মার্কিন অভিনেতা জেরেড লেটো এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।তিনি শুটিংয়ের সময় সহ-অভিনেতাদের ভয়ঙ্কর উপহার পাঠাতেন (যেমন মৃত ইঁদুর), জোকারের মানসিক অবস্থা ধরে রাখতে গিয়ে বাস্তব জীবনেও অদ্ভুত আচরণ করতেন।
নিজেকে পুরোপুরি চরিত্রে প্রবেশ করাতে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ সিনেমার নায়ক রবার্ট ডি নিরো ট্যাক্সি চালানো শুরু করেন, যার ফলে বাস্তব জীবনেও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়।
৪. শরীর-সচেতনতা বিকার
চরিত্রের জন্য অতিরিক্ত ওজন কমানো/বাড়ানো করতে গিয়ে আত্মমর্যাদা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
দ্যা মেশিনিস্ট সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ক্রিশ্চিয়ান বেল ২৮ কেজি ওজন কমিয়ে নিজের শরীরকে প্রায় কঙ্কাল বানিয়ে ফেলেন। এর ফলে শরীরিক দুর্বলতা ও মানসিক ক্লান্তি দেখা দেয়।
লা মিজারেবলস এ অভিনয়ের জন্য আনা হাথাওয়েও চরিত্রের প্রয়োজনে কয়েক সপ্তাহে ১০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছিলেন। পরে তিনি বলেন, “ এটি আমার মনের ওপর দিয়ে গিয়েছিল।
৫. পারফরম্যান্স অ্যাঙজাইটি সিনড্রোম
অনেক জনপ্রিয় অভিনেতাও নিজের কাজ নিয়ে সন্দেহে ভোগেন, ভাবেন তারা এই জায়গার যোগ্য নন। যেমন অস্কার জয় করার পরও তার মাথায় সবসময় থাকত—”আমি তো আসলে তেমন কিছুই না, এটা সব ভুল হচ্ছে।”
অভিনেত্রী এমা স্টোন বলেছেন, “আমার সবসময়ই মনে হতো আমি ধরা পড়ে যাব।”
এছাড়া কোনও কোনও সময় সিনেমার কলাকুশলীরা পোস্ট ট্রমাটিক সিনড্রোমে (পিটিএসডি) ভোগেন। যুদ্ধ, নির্যাতন বা ভৌতিক সিনেমায় অভিনয় কিংবা ফলে অবচেতনে থেকে যায় ট্রমার ছাপ। আবার কাজের চাপও ট্রমা তৈরি করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে ‘দ্য শাইনিং’ সিনেমার অভিনেত্রী শেলি ডুভালের কথা টানা যেতে পারে।
পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিক এই সিনেমার জন্য তাকে প্রচুর মানসিক চাপ দিয়েছেন। এর একটি দৃশ্যের জন্য তাকে ১২৭টি রিটেক দিতে হওয়ায় শেলি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে পিটিএসডি- এর মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
অ্যান্ডি কাফম্যান চরিত্রে অভিনয়ের পর জিম কেরিও নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলেছিলেন, দীর্ঘ সময় নিজেকে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতেন।

দর্শকদের মানসিক রোগ
দর্শকদের কাছেও সিনেমা দেখা মানেই কি শুধু পপকর্ন আর প্রেম? একদম নয়! এটা একটা মনের রোলারকোস্টার— যেখানে হাসি-কান্না, উত্তেজনা, অবিশ্বাস আর কল্পনার ঢেউ একসঙ্গে ধাক্কা খায়। কিছু সিনেমা মন ছুঁয়ে যায়, আবার কিছু সিনেমা মনটাই উল্টে দেয়! কিন্তু এই বিনোদনের জগৎ থেকেই দর্শকেরও কিছু অদ্ভুত মানসিক সমস্যার জন্ম হতে পারে।
১. হিরো-হিরোইন সিনড্রোম (এইচএইচএস)
অ্যাকশন বা রোমান্টিক সিনেমা দেখার পর হিরো-হিরোইনের মতো সাহসী বা রোমান্টিক হওয়ার ইচ্ছা জাগে। কেউ কেউ বাস্তবেও স্টান্ট করার চেষ্টা, অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস, এবং বন্ধুদের সামনে বড়াই করার চেষ্টা চালান। আর এর প্রভাবে বাস্তব জীবনে ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং বন্ধুদের মধ্যে হাসির পাত্র হওয়া লাগে কারও কারও।
২. প্লট-টুইস্ট ফোবিয়া
থ্রিলার সিনেমা দেখার পর চারপাশের সবকিছুতে সন্দেহ জাগে। দর্শকদের কেউ কেউ সাধারণ কথাবার্তাতেও ষড়যন্ত্র খোঁজা, এবং কাছের মানুষদের অবিশ্বাস করা শুরু করে। এর প্রভাবে মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে।
৩. গানে-গানে জীবন সিনড্রোম
রোমান্টিক সিনেমার গান শুনে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সিনেমার মতো সুন্দর করার ইচ্ছা জাগে। অনেক দর্শকই সারাক্ষণ গান শোনা, এবং বাস্তব জীবনে রোমান্টিক মুহূর্ত খোঁজার চেষ্টা করেন। মানসিক এ অবস্থার কারণে বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার সংঘাত, এবং মানসিক হতাশা তৈরি হতে পারে।
৪. সিনেমাটিক ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার
দুঃখের সিনেমা দেখার পর জীবনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে। বিষণ্ণতা, হতাশা, এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে।
৫. সিক্যুয়েল অবসেশন ডিসঅর্ডার
ভালো সিনেমা দেখার পর এর সিক্যুয়েলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন কোনও কোনও দর্শক। তবে সিক্যুয়েলের তথ্য খোঁজা, বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করা, এবং অধৈর্য হয়ে পড়ে কেউ কেউ মানসিকভাবে বিকারগ্রস্তও হয়ে পড়েন। এর ফলে বাস্তব জীবনের কাজকর্মে মনোযোগের অভাব এবং মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
৬. ডায়লগ রিপিটিটিভ সিনড্রোম
সিনেমার জনপ্রিয় সংলাপগুলো বাস্তব জীবনে অসংলগ্নভাবে বারবার ব্যবহার করা এ রোগের লক্ষণ। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক কথাবার্তায় বন্ধু ও স্বজনদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান। ফলে সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং হাস্যকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
৯. ভিলেন-প্রীতি ফ্যান্টাসি
সিনেমার ক্যারিশম্যাটিক ভিলেনদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এই মানসিক রোগের লক্ষণ। এর ফলে খারাপ মানুষদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো, এবং নৈতিকতা ভুলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।
১০. টাইম-ট্রাভেল টেনশন
সায়েন্স ফিকশন সিনেমা দেখে টাইম মেশিনের মতো অলৌকিক ক্ষমতা চাওয়া, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, এবং অবাস্তব কল্পনা করাও একটি মানসিক রোগ, যাতে দর্শকদের কাউকে কাউকে আক্রান্ত হতে দেখা গিয়েছে।
১১. ট্রুম্যান সিনড্রোম
এই মানসিক অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেন যে তার জীবনটি একটি রিয়ালিটি শো, সবাই তাকে গোপনে দেখছে বা পরিচালনা করছে। এই রোগের নাম এসেছে ১৯৯৮ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘দ্য ট্রুম্যান শো’ থেকে। সিনেমাটি দেখার পর অনেকেই এমন মানসিক বিভ্রান্তিতে ভুগেছেন।
১২. ওয়েদারিং হাইটস ইফেক্ট বা মেলোড্রামাটিক ইনফ্লুয়েন্স
রোমান্টিক বা ট্র্যাজিক সিনেমা দেখে কিছু মানুষের মধ্যে চরম আবেগপ্রবণতা দেখা যায়, যা মানসিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন এই ধারা চললে বিষণ্ণতা তৈরি হতে পারে।
১৩. হরর সিনেমা ও পোস্ট ড্রামা
অতিরিক্ত হরর সিনেমা দেখার ফলে কারও কারও ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা, আতঙ্কিত হয়ে ওঠা, এমনকি ফোবিয়া পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।
১৪. সিনেমা আসক্তি
প্রতিনিয়ত সিনেমা না দেখলে অস্থিরতা, বিরক্তি, একাকিত্ব, বাস্তব জীবনের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এটা ডোপামিন ডিপেন্ডেন্সের এক ধরনের রূপ—মন ভালো করার জন্য বারবার নতুন নতুন কনটেন্ট খোঁজা।
সিনেমা আমাদের বিনোদন দেয়, ভাবায়, কাঁদায় আর হাসায়। তবে যখন সিনেমা বাস্তবতাকে ঢেকে দেয়, তখনই শুরু হয় বিপদ। বিনোদনের আস্বাদ নিন—কিন্তু ভারসাম্যের সাথে। জীবনের সিনেমাটা কিন্তু পরিচালনা করেন দর্শক নিজেই।


