Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫

মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস কেন রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতল

metal
[publishpress_authors_box]

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রসায়নের মূল ক্ষেত্র ছিল ক্রমশ জটিল অণু তৈরি করা। কিন্তু শিগগিরই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন, এই সমস্ত অণু তাদের নিজস্ব সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

২০২৫ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তিনজন বিজ্ঞানীকে, যারা সেই সীমানাকে এক নতুন মাত্রায় প্রসারিত করেছেন। সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন ও ওমর ইয়াঘি এই সম্মান পেয়েছেন মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (এমওএফএস) আবিষ্কারের জন্য। এটি ছোট ছোট আণবিক কাঠামো, কিন্তু এর ভেতরে বিশাল ফাঁকা জায়গা থাকে, যেখানে অন্যান্য পরমাণু ও অণু চলাচল, প্রতিক্রিয়া বা অবস্থান করতে পারে।

এমওএফ কী?

এমওএফ হলো এক ধরনের স্ফটিক কাঠামো, যেখানে ধাতব আয়নগুলো নোড বা সংযোগবিন্দুর কাজ করে এবং জৈব অণুগুলো সংযোগকারী হিসেবে কাজ করে। এর ফলে তৈরি হয় এমন এক কাঠামো যার অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল হতে পারে প্রতি গ্রামে হাজার হাজার বর্গমিটার। এর গহ্বর বা ছিদ্রগুলো এমনভাবে নকশা করা যায়, যাতে তা নির্দিষ্ট অণুকে আকর্ষণ করতে বা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

রসায়নবিদরা এমওএফ’কে বৃহত্তর একটি পরিবারভুক্ত পদার্থ হিসেবে দেখেন, যাকে বলা হয় ‘কো-অর্ডিনেশন নেটওয়ার্ক’। তবে এমওএফ’এর বৈশিষ্ট্য হলো এর নিয়ন্ত্রিত ছিদ্রময়তা। নির্মাণ উপাদানগুলো সচেতনভাবে বেছে নিয়ে গবেষকরা এর গহ্বরগুলোর আকার, আকৃতি এবং অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এই কারণেই এমওএফ’কে এখন পর্যন্ত তৈরি সবচেয়ে বহুমুখী পদার্থগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়।

রবসন ও কিতাগাওয়া কী করেছিলেন

১৯৭০-এর দশকে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড রবসন ছাত্রদের বোঝানোর জন্য বল-অ্যান্ড-স্টিক মডেল তৈরি করছিলেন, যাতে দেখা যায় পরমাণুগুলো কীভাবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়। তখন তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিটি পরমাণুর মডেলে গর্তের অবস্থানই আসলে নির্ধারণ করে দেয় অণুর আকৃতি কেমন হবে। তিনি ভাবলেন, যদি এই যুক্তি ছোট অণুর ক্ষেত্রে সত্য হয়, তবে কি এটি বড় কাঠামোতেও প্রযোজ্য হতে পারে?

এক দশক পর, রবসন তামা আয়ন ব্যবহার করে এক পরীক্ষা চালান, যা সাধারণত টেট্রাহেড্রাল বিন্যাসে যুক্ত হতে ভালোবাসে। তিনি এই আয়নগুলিকে এমন এক জৈব অণুর সঙ্গে যুক্ত করলেন, যার চারটি বাহু নাইট্রাইল গ্রুপে শেষ হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, জটিল জটের বদলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক হীরার মতো স্ফটিক কাঠামোয় বিন্যস্ত হয়ে গেল। 

এই জালিকা হীরার মতো ঘন ছিল না; বরং ভেতরে অনেক ফাঁকা গহ্বর ছিল, যেখানে অন্যান্য অণু অবস্থান করতে পারত। রবসন অনুমান করেছিলেন, এমন “ফ্রেমওয়ার্ক” বিশেষভাবে নকশা করে আয়ন আটকে রাখা, রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং আকার অনুযায়ী অণু ছেঁকে ফেলার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

তবে রবসনের প্রথম দিকের স্ফটিকগুলো ছিল খুবই ভঙ্গুর। জাপানের সুসুমু কিতাগাওয়া সেই কাঠামোগুলোকে স্থিতিশীল ও কার্যকর করে তুলেছিলেন। “ইউসফুলনেস ইন দ্য ইউসলেস” দর্শন মেনে কিতাগাওয়া এমন সব ছিদ্রময় পদার্থ নিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন, যা শুরুতে অতিরিক্ত দুর্বল মনে হয়েছিল। 

১৯৯৭ সালে তিনি কোবাল্ট, নিকেল বা জিংক আয়ন এবং ৪,৪’-বাইপাইরিডিন নামে একটি সেতুবন্ধনকারী অণু ব্যবহার করে এক প্রকৃত ত্রিমাত্রিক এমওএফ তৈরি করেন। এই পদার্থ শুকিয়ে আবার গ্যাসে ভর্তি করা হলেও যেমন মিথেন, নাইট্রোজেন বা অক্সিজেনের কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকত।

কিতাগাওয়া আরও আবিষ্কার করেন যে এমওএফ সবসময় শক্ত নয়; বরং এর অণু সংযোগগুলো নমনীয় হতে পারে। ফলে তাপমাত্রা, চাপ এবং এর ভেতরের অণুর ধরন অনুযায়ী এগুলো প্রসারিত, সংকুচিত বা বাঁকতে পারে।

ইয়াঘির অবদান কী

যুক্তরাষ্ট্রে ওমর ইয়াঘি এমওএফ’কে এনে দেন কাঠামোগত দৃঢ়তা ও পুনর্নির্মাণযোগ্যতা। জর্ডানে সাধারণ এক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ইয়াঘি ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ ছিলেন রসায়নের সেই ক্ষমতায়, যা বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। 

১৯৯০-এর দশকে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি এমন একটি উপায় খুঁজছিলেন, যাতে ধাতব আয়নকে সংযোগবিন্দু এবং জৈব অণুকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সচেতন নকশায় বিস্তৃত পদার্থ তৈরি করা যায়।

১৯৯৫ সালে তিনি প্রথম এমন দ্বিমাত্রিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেন, যা কোবাল্ট বা তামা আয়নের মাধ্যমে যুক্ত ছিল এবং অন্যান্য অণুকে ধারণ করতে পারত কাঠামো ভেঙে না গিয়ে। চার বছর পর, তিনি তৈরি করেন এমওএফ-৫ একটি দৃঢ় ত্রিমাত্রিক জালিকা যা জিংক আয়ন এবং বেঞ্জিন-ডিকার্বক্সিলেট সংযোগকারী দিয়ে তৈরি। এমওএফ-৫ এতটাই শক্ত ছিল যে কয়েক গ্রাম পদার্থের অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল একটি ফুটবল মাঠের সমান ছিল। এটি ৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও স্থিতিশীল থাকত এবং ভেতরের ‘অতিথি’ অণু সরিয়ে ফেললেও অক্ষত থাকত।

২০০০-এর দশকের শুরুতেই ইয়াঘির দল এমন বহু এমওএফ পরিবার তৈরি করে ফেলেছিল, যেগুলোর মৌলিক জ্যামিতি একই থাকলেও ছিদ্রের আকার ও কার্যকারিতা ভিন্ন ছিল।

এমওএফ কেন গুরুত্বপূর্ণ

ভাবুন, একটি টেনিস বল আছে যার পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল এক্স। এর বাইরের স্তর যদি ৫ মিলিমিটার পুরু হয়, তবে বলটি কেটে খুললে মোট পৃষ্ঠফল হবে ২ দশমিক ২ গুণ এক্স (এর গাণিতিক প্রমাণ দেওয়া যায়)। অর্থাৎ, কোনও নতুন পদার্থ না যোগ করেই শুধুমাত্র কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে পৃষ্ঠফল ২ দশমিক ২ গুণ বৃদ্ধি পেল! এই উদাহরণই এমওএফ এর আকর্ষণের একাংশ ব্যাখ্যা করে। অন্য অংশটি হলো, এগুলোকে রসায়নবিদরা কত সহজে বিভিন্ন প্রয়োজনে নকশা করতে পারেন।

ক্যাল্ফ-২০ নামের একটি এমওএফ এখন শিল্প কারখানার ধোঁয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড দক্ষতার সঙ্গে ধরতে সক্ষম, এবং এটি ইতিমধ্যেই শিল্প পর্যায়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এমওএফ-৩০৩ মরুভূমির শুষ্ক বাতাস থেকে রাতের বেলায় জলীয় বাষ্প শোষণ করে এবং সূর্যের আলোয় তা জল হিসেবে ছাড়তে পারে। ইউআইও-৬৭ পানি থেকে বিপজ্জনক “ফরএভার কেমিক্যাল” সরাতে পারে। মিল-১০১ ও ও জেডআইএফ-৮ দূষক ভাঙার গতি বাড়ায় এবং বর্জ্য পানির মধ্যে থেকে বিরল ধাতু পুনরুদ্ধার করতে পারে।

জ্বালানি খাতে, এনইউ-১৫০১ ও এমওএফ-১৭৭ নিরাপদে হাইড্রোজেন বা মিথেন সঞ্চয় করতে পারে মাঝারি চাপে, যা পরিচ্ছন্ন জ্বালানি চালিত যানবাহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, কিছু এমওএফ বিষাক্ত গ্যাস ধারণ করতে ব্যবহৃত হয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে। আবার কিছু এমওএফ কাজ করে ওষুধ সরবরাহের ক্যাপসুল হিসেবে, যা শরীরের ভেতরের সংকেতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ওষুধ ছাড়ে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত