গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের পটভূমিতে সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে ফ্রান্স। ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে আগামী জুনে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলনে এ পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
এর বিপরীতে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারে, এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)। তারা বলেছে, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফরাসি রাষ্ট্রনেতা জানান দিলেন যে তিনি ‘সঠিক পথে’ হাঁটছেন।
গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলা ইসরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যেই ১০টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে মেক্সিকো, আর্মেনিয়া, স্লোভেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, স্পেন, বাহামা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, জ্যামাইকা ও বার্বাডোজ।
এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন দিনকে দিন বাড়ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তার আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী হয়; ফিলিস্তিনের ভূ-খণ্ড দখল করার জন্য ইসরায়েল কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার সক্ষমতা সৃষ্টি হয় এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়ে।
কার কার স্বীকৃতি পেয়েছে ফিলিস্তিন
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশসহ ১৪৭টি সার্বভৌম দেশ হিসাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৭৫ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে ক্যাথলিক চার্চ ও ভ্যাটিকান সিটির পরিচালনা পর্ষদও, যার জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মর্যাদা রয়েছে।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম বিদ্রোহ বা ইন্তিফাদার শুরুর দিকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৮০টির বেশি দেশ স্বীকৃতি দেয়। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আরব বিশ্ব তথা গ্লোবাল সাউথ এই স্বীকৃতিতে দৃঢ় সমর্থন জানায়।
সে সময় যেসব ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটভুক্ত ছিল।
ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইয়াসির আরাফাতের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক বছর পর ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের প্রথম সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয় অসলো চুক্তি।
এই চুক্তিতে ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।
তবে অসলো চুক্তি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি।
গত শতকে আশি ও নব্বই দশকের শুরুতে প্রায় ২০টি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। এরপর ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আরও ১২টি দেশ থেকে স্বীকৃতি পায় ফিলিস্তিনিরা। এসব দেশের বেশির ভাগই আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার।
২০১১ সালের মধ্যে ইরিত্রিয়া ও ক্যামেরুন বাদে আফ্রিকা মহাদেশের সব দেশই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় (পক্ষে ১৩৮টি, বিপক্ষে ৯টি এবং ৪১টি ভোটদানে বিরত) ফিলিস্তিনের মর্যাদা ‘সদস্যহীন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রে’ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর দুই বছর পর ২০১৪ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সুইডেনই প্রথম ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।
তালিকায় ইউরোপের আরও দেশ
২০২৪ সালের ২২ মে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড ও স্পেন পর্যায়ক্রমে ঘোষণা দেয়, তারা ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমানা অনুযায়ী এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী ধরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ওই তিন ইউরোপীয় দেশ থেকে তার রাষ্ট্রদূতদের ফিরিয়ে নেয় এবং শাস্তিস্বরূপ অধিকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করে।
গত বছরের জুনের ৪ তারিখে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া ইউরোপীয় দেশের তালিকায় যুক্ত হয় স্লোভেনিয়ার নাম।
মাল্টা এবং বেলজিয়ামের মতো ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে কখন এবং কীভাবে স্বীকৃতি দেবে, এ নিয়ে আলোচনা করছে।
স্বীকৃতি দেয়নি কারা
কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র – বিশ্বের উন্নত সাত দেশের সংগঠন জি৭ এর এই সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কোনোটিই এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নেয়নি।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা