Beta
শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

টেবিল টেনিসের ‘বিপ্লব’ ঘটাতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সারা দেশে টেবিল টেনিস ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগের অংশ হিসেবে কর্মকর্তা বিভিন্ন জেলায় ঘুরে অনুশীলন দিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
সারা দেশে টেবিল টেনিস ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগের অংশ হিসেবে কর্মকর্তা বিভিন্ন জেলায় ঘুরে অনুশীলন দিচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

এক সময় দেশের টেবিল টেনিসের উর্বর ভূমি বলা হতো নড়াইলকে। টেবিল টেনিসের ৬০ ভাগ খেলোয়াড়ই নড়াইল জেলার। শুধু তাই নয় জাতীয় পুরুষ ও মহিলা দলের ৭৫ ভাগ খেলোয়াড়ই উঠে এসেছে এই জেলা থেকে।

অথচ নড়াইলে নেই কোনও আধুনিক প্রশিক্ষণ অবকাঠামো। শুধু একটি টিনশেড ঘরে দুইটি টেবিল পাতা। অনেক খেলোয়াড় অপেক্ষায় থাকেন কখন অন্যদের অনুশীলন শেষ হবে। ভ্যাপসা গরম। কোচদেরও পারিশ্রমিক নামমাত্র। ফ্যান, ম্যাট, ওয়াশরুম,  ড্রেসিংরুমের অভাব। তবু দিনের পর দিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিভাবান খেলোয়াড় এক সময় তৈরি হতো নড়াইল থেকে।

বাস্তবতা হচ্ছে দিনের পর দিন খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি ও সুযোগ-সুবিধার সঙ্কটে নড়াইলের পাইপলাইন সঙ্কুচিতই হচ্ছে। কমে যাচ্ছে নতুন প্রতিভাও।

দেশের সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়া জেলারই যখন এই দুরবস্থা, অন্য জেলাগুলো থেকে খেলোয়াড় তুলে আনার কথা ভাবাও দুস্কর।

তবে সম্প্রতি দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এসব প্রতিভবান টেবিল টেনিস খেলোয়াড় তুলে আনার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ৫ মে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন দেয় সরকার।   

নড়াইলের কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার পর কর্মকর্তাদের সঙ্গে খেলোয়াড়েরা। ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় টেবিল টেনিস সম্প্রসারণের (টেবিল টেনিস এক্সপানসন ইনিশিয়েটিভ) উদ্যোগ গ্রহণে যে কমিটি করা হয়েছে। কমিটির চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব ও সাবেক খেলোয়াড় আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ। কমিটির অন্য সদস্যরাও সবাই সাবেক চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়। যাদের বলা হচ্ছে চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা।

এই কমিটিতে রয়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়া খেলোয়াড় জোবেরা রহমান লিনু, সাইদুল হক সাদী, সৈয়দ আবেদ হোসেন, আল মারুফ এনায়েত হোসেন, সৈয়দ বখতিয়ার উদ্দিন মাহমুদ ও ড. আখলাকুর রহমান। সদস্য হিসেবে আছেন টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন মাকসুদ আহমেদ সনেট।  

যেভাবে কাজ করবে এই কমিটি

কমিটির অন্যতম সদস্য সৈয়দ বখতিয়ার উদ্দিন মাহমুদ বলেন, “ আমরা শুরুতেই ৬৪ জেলায় যেতে চাই না। যেখানে আগে নিয়মিত টেবিল টেনিস খেলা হতো কিন্তু এখন থমকে আছে এমন জেলাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এসব জেলাগুলোকে কিভাবে জাগিয়ে তোলা যায় সেটাই আমরা দেখব।”

এরই মধ্যে যশোর ও নড়াইলে দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়েছে। গত ২১ জুন যশোরে জেলা ক্রীড়া সংস্থার জিমনেসিয়ামে ও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনস্থ শিশু পরিবারের খেলোয়াড়দের অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন ২২ জুন নড়াইলে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্থানীয় কোচদের অধীনে চলছে নতুন করে টেবিল টেনিস অনুশীলন।

চলতি জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় কার্যক্রম চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে এই কমিটির।

শুরুতেই দারুণ সাড়া মিলেছে বলে জানালেন কমিটির অন্যতম সদস্য আল মারুফ এনায়েত হোসেন, “যশোর ও নড়াইলের ছেলে মেয়েরা এই কার্যক্রমে খুব খুশি। সেখানে ১৫ দিনের ক্যাম্প শুরু হবে। এরপর ৩ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে আরেকটি ক্যাম্প চালু করা হবে।”

যশোরে এক সময় নিয়মিত টেবিল টেনিসের চর্চা হলেও বর্তমানে ভেন্যু সঙ্কটে তা থমকে আছে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “২০০৩ সালের পর থেকে যশোরে টেবিল টেনিস থেমে আছে। ওখানকার ভেন্যু হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন খেলা হয় জিমসেয়িমানে। কিন্তু সেখানে টেবিল রাখারও জায়গা নেই।”

যশোর জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর স্থানীয় জেলা ক্রীড়া সংস্থার পাশের কক্ষ সংস্কার করে টেবিল টেনিস অনুশীলন শুরু করা হয়েছে।

আল মারুফ এনায়েত হোসেন জুনিয়রদের ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন, “ আমাদের স্লোগান সবার জন্য টেবিল টেনিস। আমরা সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছি অনূর্ধ্ব-১০ বছর বয়সীদের। এরপর প্রি ক্যাডেট, ক্যাডেট, জুনিয়র অনূর্ধ্ব-১৬ ও ১৮। এই ইভেন্ট সারা দেশে চালু করতে পারলে এক পর্যায়ে দেশের পাইপলাইনে খেলোয়াড় সঙ্কট থাকবে না।”

উদহারণ হতে পারে লামার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

২০১৩ সালে শুধু একটি একাডেমিকে কেন্দ্র করে টেবিল টেনিস চর্চার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল লামায়। টেবিল টেনিস ফেডারেশনের মাধ্যমে যেটির উদ্যোগ নেন আল মারুফ এনায়েত হোসেনসহ অন্যরা। বান্দরবানের লামায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী বিদ্যালয়ে সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীরা পরবর্তীতে এই খেলায় প্রচুর আগ্রহী হয়ে ওঠে। বর্তমানে এই ফাউন্ডেশন থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়েরাই জাতীয় পর্যায়ে টেবিল টেনিসে সাফল্য পাচ্ছেন। এখান থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন রামহিম লিয়ন বম, খৈ খৈ সাই মারমা, রেশমি তঞ্চঙ্গ্যার মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ২০১৯ ও ২০২৪ সালের শীতকালীন জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হয়েছে চ্যাম্পিয়ন। লামা উপজেলা ও বান্দরবানের জেলা পর্যায়ে কোয়ান্টামের খেলোয়াড়রা চ্যাম্পিয়ন হয়। পরে তারা চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়েও পদক জেতে।

২০২৪ সালের ৫২তম শীতকালীন জাতীয় প্রতিযোগিতায় কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের শিক্ষার্থীরা সাতটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে পাঁচটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়, যেগুলোর মধ্যে টেবিল টেনিস বালক (একক ও দ্বৈত) এবং বালিকা (একক) ইভেন্টও রয়েছে।

দেশের যে সব জেলায় চলে টেবিল টেনিস চর্চা

একেবারে বিচ্ছিন্নভাবে নিবু নিবু করে জ্বলছে নড়াইলের টেবিল টেনিস অনুশীলন। এর বাইরে রাজশাহীর দুর্গাপুর আন্দুয়ায় নজরুল টেবিল টেনিস একাডেমিতে কিছু কিশোরদের অনুশীলন দেওয়া হয়। গাইবান্ধায় মোমিনুল হকের উদ্যোগে বিনা পারিশ্রমিকে শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার অধীনে ১৪ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যাদের মধ্যে ৪ জন বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছে। স্থানীয় হিসেবেও ‘মফস্বল শহরে’ এই খেলা ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালীতেও বিভাগীয় টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে চর্চা বাড়ছে।

তবুও আশাবাদী চেয়ারম্যান

যেখানে গত ৬ বছরে ২টি লিগ আয়োজন করতে পারেনি টেবিল টেনিস ফেডারেশন। নিয়মিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেরও আয়োজন করা হয় না। সেখানে এমন উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে? কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক খেলোয়াড় আবু মমতাজ সাদি বিন কিসলু এই সম্প্রসারণ কার্যক্রম নিয়ে দারুণ আশাবাদী। তিনি বলেন, “আশা করছি এটা আমরা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারব। কারণ আমরা এটা নিয়ে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছি। এখান থেকেই উঠে আসবে ভবিষ্যতের টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। যে সব প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের যদি ভালোভাবে অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ দিতে পারি তাহলে এরাই পরবর্তীকালে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।”

আরও পড়ুন

সর্বাধিক পঠিত