৩ এপ্রিল, ২০১৮। রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন কলেজে যাচ্ছিলেন বিআরটিসির একটি বাসে চড়ে।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন দোতলা বাসটির পেছনের ফটকে দাঁড়ানো রাজীবের ডান হাতটি ছিল সামান্য বাইরে। কারওয়ান বাজার এলাকায় সার্ক ফোয়ারার কাছে হঠাৎ করেই ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিক ঘেঁষে পড়ে।
এসময় দুই বাসের প্রবল ঘষায় রাজীবের ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; বাসের দরজায় ঝুলে থাকে সেই হাত। রাজীব রাস্তায় পড়ে মাথায় মারাত্মক আঘাত পান। তাকে প্রথমে বেসরকারি শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হয়, পরে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে একপর্যায়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে তার অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসকদের শত চেষ্টায়ও তার সেই হাত জোড়া লাগেনি। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ এপ্রিল মৃত্যু হয় রাজীবের।
দুই বাসের ফাঁকে ঝুলে থাকা রাজীবের বিচ্ছিন্ন হাতটির ছবি বহু মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতীক হয়ে ওঠে রাজীবের সেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে থাকা হাত। ঝুলে থাকা সেই হাত যেন বুঝিয়ে দেয় সড়কে মানুষের জীবনও ঝুলেই থাকে।
রাজীবের গ্রামীর বাড়ি পটুয়াখালী; তিনি ঢাকায় থাকতেন যাত্রাবাড়ী। রাজীব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার মা মারা যান; তার কিছু দিন পর থেকে তার বাবাও নিরুদ্দেশ।
তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল ২১ বছর বয়সী রাজীব। তাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে, ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে ঢাকায় কলেজের পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটার কম্পোজ, গ্রাফিকস ডিজাইন শিখছিলেন রাজীব। সঙ্গে ছাত্রও পড়াতেন। কিন্তু রাজীবের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, ছোট ভাইদের দায়িত্ব নেওয়ার সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় দুই বাসের রেষারেষিতে।
সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির যখন মৃত্যু হয় বা তিনি যখন পঙ্গু হয়ে যান, তখন সে পরিবারটির কী পরিস্থিতি হয়? অথবা দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসে যখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, তখন সে পরিবারের কতটুকুই আর বাকি থাকে নিঃস্ব হতে? তাদের মানসিক অবস্থাই বা কেমন দাঁড়ায়?
এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে। তারা বলছেন, আর্থিক সঙ্কট, জীবিকা নির্বাহে সমস্যা, মানসিক চাপ, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাসহ নানা ধরনের ট্রমায় আক্রান্ত হয় এমন একটি পরিবারের সবাই। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিয়ে বাংলাদেশে আইন রয়েছে। তবে বেশিরভাগ মানুষই আর্থিক ক্ষতিপূরণের কথা জানে না। আবার কেউ ক্ষতিপূরণের মামলা করলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেই মামলাও শেষ হয় না, জোটে না ক্ষতিপূরণও।
‘কোর্টের বারান্দায়-বারান্দায় কত ঘোরা যায়’
“যদিও কোনও মৃত্যুরই কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না”, সকাল সন্ধ্যাকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন রাজীব হোসেনের খালা জাহানারা বেগম।
রাজীবের মৃত্যুর পর দুটি মামলা হয়েছিল। দুই বাস চালককে আসামি করে মামলা হয় শাহবাগ থানায়, আরেকটি উচ্চ আদালতে। কিন্তু কোনও মামলাই শেষ হয়নি সাত বছরেও।
জাহানারা বেগম বলেন, “মামলা স্থগিত হয়ে আছে। ড্রাইভাররা জেল খেটে জামিন পেয়েছে, আর আগায়নি মামলা। তারিখের পর তারিখ পড়ে, বিচার তো পাই না। নিরাশ হয়ে এখন আর যাইও না আমরা। কোর্টের বারান্দায়-বারান্দায় আর কত ঘোরা যায়? এত আলোচনা হলো রাজীবের মৃত্যু নিয়ে। সেই মামলারই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে বুঝে দেখেন, সাধারণ মানুষের কী অবস্থা।
“কিন্তু যদি একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, যদি মানুষ দেখ তো যে বিচার হয়েছে, শাস্তি হয়েছে তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও চালকদের মনে ভয় ঢুকতো, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।”
রাজীবের সেই বিচ্ছিন্ন হাতের ছবি দেখে ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সকাল সন্ধ্যাকে জানান, হাইকোর্ট বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনকে হাত হারানো রাজীব হোসেনের চিকিৎসা ব্যয় বহনের নির্দেশ দিয়েছে। স্বজন পরিবহন রাজীবের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাইকোর্টের ৫০ লাখ টাকা দেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই আপিল এখনও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) যথেচ্ছ নজরদারি, দুর্নীতি সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ। লাইসেন্স, ফিটনেস ও রুট পারমিট পাচ্ছে অযোগ্যরা। সেইসঙ্গে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কারণে অনিয়ন্ত্রিত, অদক্ষ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের সংখ্যা বেড়েই যায়, আর দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর মনিটরিং ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
তারা জানিয়েছেন, অতি সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুটা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। তবে সেটা বেশ জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। রয়েছে সচেতনতার অভাবও।
বিআরটিএর হিসাবে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ৪৭১টি পরিবার ৬৫ কোটির কিছু বেশি টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৯০৪ জনের।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) হেলথ সিস্টেম রিসার্চ ডিভিশনের পরিচালক সেলিম মাহমুদ চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ক্ষতিপূরণ পেতে দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। কিন্তু এটা আসলে একটা দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয় না।
সেলিম মাহমুদ চৌধুরী বলেন, হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে মাত্র পাঁচ শতাংশেরও কম পরিবার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ অনেক দুর্ঘটনার খবর নেই।
অথচ ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহণ আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ এবং আহত, অঙ্গহানি বা পঙ্গু হলে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। আইনে একটি পৃথক আর্থিক সহায়তা তহবিল এবং ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করার কথা ছিল। সেগুলো হলেও যথেষ্ঠ কার্যকারিতা নেই।
‘পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়’
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আহত হয় আরও অন্তত ৩৫ হাজার। এদের বড় অংশই কর্মক্ষম। আহতদের অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করায় পরিবারগুলো দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে।
“সড়ক দুর্ঘটনায় যারা গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে থাকেন তাদের জীবনটা হয়ে যায় দুর্বিসহ। কেবল তার নয়, পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়,” সকাল সন্ধ্যাকে বলছিলেন ফরহাদ হোসেন, যার ছেলে ফাহিম হোসেন দুর্ঘটনায় এক হাত আর এক পা হারিয়েছেন।
বৃদ্ধ বাবা-মাসহ পাঁচজনের সংসারে ফাহিম হোসেনই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
ফাহিমের চিকিৎসায় ইতোমধ্যে ৫০-৫৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, “ডাক্তাররা বলছে আরও চিকিৎসা লাগবে, অনেক কিছু করতে হবে। কিন্তু এত টাকা খরচ হইছে, আরতো কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছি না। ধার করতে হবে, জমিজমা বিক্রি করতে হবে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৪ হাজার ৯৫৪ জনের মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়, তাদের মধ্যে ১৫ বছর থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে রয়েছে ৬৭ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের বয়সীরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক ব্যক্তির গড়ে চিকিৎসা খরচ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। দুর্ঘটনার পরপরই জরুরি অস্ত্রোপচার, আইসিইউ সেবা, ওষুধপত্র এবং দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি- সব মিলিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এ খরচ সামলানো প্রায় অসম্ভব।
কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সড়ক দুর্ঘটনায় বেশি মারা যাচ্ছে জানিয়ে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে; জিডিপিতে ক্ষতি পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ।”
তিনি বলেন, “ক্ষতিপূরণের জন্য যেসব কাগজপত্র দিতে হয় সেগুলো পর্যালোচনা করার জন্য মাত্র একমাস সময়। মানুষ তো স্বাভাবিকই হতে পারে না মৃত্যুর পর অথবা আহত হলে হাসপাতাল-চিকিৎসার জন্য। এই কয়দিনের মধ্যে সে কী করে এসব করবে? আর যেহেতু প্রক্রিয়াটা সহজ নয়, তাই অনেকেই এই ঝামেলায় যেতে চায় না।”
সদক দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ পেতে যেন ভোগান্তি কমে এবং মানুষ যেন সহজেই ক্ষতিপূরণ পায়- সেজন্য যাত্রীকল্যাণ সমিতি কাজ করছে বলে জানান সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক।