জাকসু নির্বাচনের এক দিন আগেও সোশাল মিডিয়ায় আলোচনা অমর্ত্য রায়ের ভিপি প্রার্থী হতে না পারা নিয়ে।
তাকে বাদ রেখেই ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আর বাদ দেওয়ার এই প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকেও।
জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯২ সালের পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন আয়োজন হতে যাচ্ছে। নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনে বৃহস্পতিবার ভোট দেবে ১১ হাজার ৯১৯ শিক্ষার্থী।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ জাকসুতে ২৫ পদের জন্য লড়াইয়ে রয়েছে ১৭৭ জন। তার মধ্যে ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ৮ জন প্রার্থী। হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৪৪৫ জন।
বাম সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অমর্ত্য রায়। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একবার বহিষ্কৃত হওয়া অমর্ত্যকে অনিয়মিত হওয়ার কারণ দেখিয়ে তার প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
তার বিরুদ্ধে হাই কোর্টে রিট আবেদন করে পক্ষে আদেশ এনেছিলেন এই শিক্ষার্থী; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে গেলে হাই কোর্টের রায় স্থগিত হয়ে যায়।
ফলে অমর্ত্যের জাকসু নির্বাচন করা হচ্ছে না।
অমর্ত্য আলোচনায় বারবার
ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্তির মধ্যে একাংশের নেতা হিসাবে বাম মহলে পরিচিত ছিল অমর্ত্য রায়ের নাম। তবে তার বড় পরিচিতি গড়ে ওঠে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়ে।
তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী গ্রাফিতি আঁকার জেরে অমর্ত্যসহ দুজনকে এক বছরের জন্য বহিষ্কারের পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল, অমর্ত্য গ্রাফিতি এঁকেছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি মুছে দিয়ে, ফলে এটা ছিল জাতির পিতাকে অবমাননা।
তবে অমর্ত্যসহ দুজনকে বহিষ্কার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলার নিন্দা জানিয়েছিল বিভিন্ন সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কসহ নাগরিক সংগঠনগুলো।
ওই বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অমর্ত্যের।
সেই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পর গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তার পাঁচ মাস পর আগের সেই মামলায় অমর্ত্যের বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে নতুন করে প্রতিবাদ শুরু হয়।
তারপর অমর্ত্যের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয় অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এরমধ্যে জাকসু নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হলে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতি জোটভুক্ত বেশ কয়েকটি সংগঠনকে নিয়ে দাঁড় করায় ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ নামের প্যানেল। সেই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী হন অমর্ত্য।
কিন্তু জাকসুর নির্বাচন কমিশন অনিয়মিত শিক্ষার্থী হওয়ার কারণ দেখিয়ে ভোটের এক সপ্তাহ আগে অমর্ত্যের প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করে।
অমর্ত্য ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন; তার আবাসিক হল আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল।
প্রার্থিতা বাতিলের পর অমর্ত্যের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়, অমর্ত্যকে যে ২০২৪ সালে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তা হিসাব করেনি কর্তৃপক্ষ। আর তাকে যে অন্যায্যভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তা ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ফলে তার অনিয়মিত হওয়ার দায় প্রশাসনের ওপরই বর্তায়।
অমর্ত্য হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে আদালত তার প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেয়। কিন্তু সেই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
প্রশাসন যুক্তি দেখায়, অমর্ত্যের প্রার্থিতা বাতিল করে তাকে বাদ রেখে ব্যালট পেপার ছাপা হয়ে গেছে, ফলে এখন অমর্ত্যকে প্রার্থী হিসাবে যোগ করতে হলে নতুন ব্যালট পেপার ছাপিয়ে নির্বাচন আয়োজন ১১ সেপ্টেম্বর করা যাবে না।
সেই যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি হাই কোর্টের রিট আবেদন স্থগিত করে দেন। ফলে অমর্ত্যকে ছাড়াই জাকসু নির্বাচন হচ্ছে।
মঙ্গলবার আদালতের স্থগিতাদেশের পর অমর্ত্য ফেইসবুকে লিখেছেন, “ব্যালেট পেপার ছাপানোর অজুহাতে আমাকে ইলেকশন করতে দেয়া হচ্ছে না। যাই হোক, জাকসু হয়তো শেষ কথা না। আপনাদের ভালোবাসা, শুভ কামনা নিয়ে সামনে আগায়ে যাবো। যারা যারা এই জার্নিতে সাথে ছিলেন/আছেন তাদের ভালোবাসা। সংগ্রামটুকু চলবে।”
জাকসু তথ্য
১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ৯ বার অনুষ্ঠিত হয়েছে জাকসু নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সেবার ছাত্রদল জাকসু এবং হল ছাত্র সংসদগুলোতে বিজয়ী হয়েছিল। জাকসুতে ভিপি হয়েছিলেন মাসুদ হাসান তালুকদার, জিএস হয়েছিলেন শামসুল তাবরীজ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়।
তফসিল ঘোষণার পর গত ১০ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয় ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর যাচাই-বাছাই, আপত্তি শুনানির পর ২৯ আগস্ট চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। ১০ দিন প্রচারের সময় দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণের দিন ঠিক করা হয়।
জাকসুতে ২৫ পদে মোট প্রার্থী এখন ১৭৭ জন। হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৪৪৫ জন।
মোট ১১ হাজার ৯১৯ ভোটারের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী।
বেগম সুফিয়া কামাল হল ও নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। ফলে এই দুই হলে শুধু কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। বেগম সুফিয়া কামাল হলে ১৫ পদের ১০টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, বাকি পাঁচ পদ শূন্য রয়েছে। নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলে ১৫ পদের ছয়টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন প্রার্থীরা, বাকি ৯টি পদ শূন্য রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, জাকসু নির্বাচনে ভোটগ্রহণে বিভিন্ন হলে ২২৪টি বুথ বসানো হবে। ব্যালট পেপারে টিক চিহ্নের মাধ্যমে ভোট দিতে হবে। প্রতি ২০০ ব্যালট পেপারের জন্য একটি বাক্স থাকবে। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের ব্যালট বাক্স আলাদা করে চিহ্নিত থাকবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ৬৭ জন পোলিং এজেন্ট এবং ৬৭ জন সহকারী অফিসার কেন্দ্রগুলোতে উপস্থিত থাকবেন, যারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি ফটকে ১ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তায় থাকবে আনসার সদস্যরা।
ভোটের দিন বৃহস্পতিবার প্রান্তিক গেইট বাদে বাকি সব ফটক বন্ধ থাকবে। ক্যাম্পাসের সব দোকান বন্ধ থাকবে, তবে হলের ভেতরের ক্যান্টিনে ও দোকানে খাবার থাকবে।
ভোটের দিন জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সবার মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে ক্যাম্পাসে। বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে ঢোকাও থাকবে নিষিদ্ধ।
৭ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
জাকসু নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সাতটি প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে; এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে অনেক।
ছাত্রদলের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী করা হয়েছে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রদলের সভাপতি মো. শেখ সাদী হাসানকে। জিএস প্রার্থী হয়েছেন ১৩ নম্বর ছাত্রী হল ছাত্রদলের সভাপতি তানজিলা হোসাইন বৈশাখী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে মো. সাজ্জাদুল ইসলাম এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে আঞ্জুমান আরা ইকরা ছাত্রদলের প্যানেলে লড়বেন।
ডাকসুতে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে জয়ী ইসলামী ছাত্রশিবির জাকসুতে লড়ছে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে। তাদের ভিপি প্রার্থী আরিফ উল্লাহ, জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে লড়বেন ফেরদৌস আল হাসান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে লড়বেন আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল এনসিপির ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল, জিএস প্রার্থী আবু তৌহিদ মো. সিয়াম। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে জিয়া উদ্দিন আয়ান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে মালিহা নামলাহ লড়ছেন।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতি সংগঠন মিলে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল ঘোষণা করে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায় থাকলেও তিনি লড়াই থেকে বাদ পড়ায় এখন জিএস প্রার্থী থাকছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসান।
১১ জন নারী, ৭ জন আদিবাসী, ৬ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী, ৩ জন বৌদ্ধ ও ২ জন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে সাজানো এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী নুর এ তামীম স্রোত এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী ফারিয়া জামান নিকি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুর রশিদ জিতুর নেতৃত্বে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী জিতুর সঙ্গে জিএস প্রার্থী রয়েছেন শাকিল আলী। এই প্যানেলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে প্রার্থী রয়েছেন তৌহিদুল ইসলাম নিবির ভূঁঞা।
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে একটি আংশিক প্যানেল দিয়েছে। এই প্যানেলে ভিপি প্রার্থী নেই, জিএস পদে লড়ছেন জাহিদুল ইসলাম ইমন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (নারী) পদে প্রার্থী হয়েছেন সোহাগী সামিয়া জান্নাতুল ফেরদৌস।
জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের একাংশের মুখপাত্র মাহফুজ ইসলাম মেঘের নেতৃত্বে আট সদস্যের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ নামে আরেকটি আংশিক প্যানেল ভোটের লড়াইয়ে রয়েছে। মাহফুজ এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী, জিএস প্রার্থী তানবীর হোসেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) পদে এই প্যানেলের প্রার্থী নাজমুল ইসলাম।