Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

আরাকান আর্মি আটকাচ্ছে জাহাজ, পড়ছে কী প্রভাব

আরাকান আর্মির কবল থেকে মুক্ত হওয়া একটি জাহাজ।
আরাকান আর্মির কবল থেকে মুক্ত হওয়া একটি জাহাজ।
[publishpress_authors_box]

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা পণ্যবাহী জাহাজ মাঝপথে আটকে দিচ্ছে আরাকান আর্মি।

রাখাইন রাজ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর গত ডিসেম্বর মাসে নাফ নদী দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয় বিদ্রোহী দলটি। এরপর দুদেশের সীমান্ত বাণিজ্য প্রায় বন্ধ ছিল। জানুয়ারিতে কোনও জাহাজ পণ্য নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে ভেড়েনি। এমনকি টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে যাত্রী-পণ্য পরিবহনেও অচলাবস্থা তৈরি হয়।

সেই জটিল অবস্থার মধ্যে ইয়াংগুন থেকে সাগর পথে রওনা হওয়া চারটি পণ্যবাহী জাহাজ টেকনাফে আসার আগেই আটকে দেয় আরাকান আর্মি। তিনটি জাহাজ অবশ্য ছেড়ে দিয়েছে। একটি এখনও রেখেছে আটকে।

জাহাজগুলো কেন আটক করেছে বা কেনইবা ছেড়ে দিল, আনুষ্ঠানিকভাবে সে বিষয়ে কিছুই জানায়নি আরাকান আর্মি।

তবে খবর নিয়ে জানা গেছে, আরাকান আর্মিকে চাঁদা দিয়েই জাহাজগুলোর মুক্তি মিলেছে। আর চাঁদা পরিশোধ করেছে জাহাজ মালিকরা। তারা মিয়ানমারের ব্যবসায়ী।

মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দর দিয়ে পণ্য আনা এখনও উম্মুক্ত নয়। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই কেবল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ড্রাফট নিয়ে পণ্য আমদানির সুযোগ পান। তা আবার নির্দিষ্ট পরিমাণে।

এর বাইরে কিছু পণ্য এবং রমজান ঘিরে বিশেষ কিছু পণ্য, আবার সংকটের সময় বিকল্প হিসাবে বেশ কিছু পণ্য মিয়ানমার থেকে দ্রুত আনার নজির আছে। তবে আরাকান আর্মির দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশের সেই সুযোগ এখন বন্ধ।

আর তা রোজার আগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। এই সময়ে যেসব পণ্য আমদানির সুযোগ ছিল, সেগুলো আসা এখন অনিশ্চিত।

কক্সবাজারের বাসিন্দা এবং ওকেএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অছিয়র রহমান বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান সকাল সন্ধ্যাকে।

তিনি বলেন, “পণ্যবাহী জাহাজ আটকের পর উদ্বেগ বাড়ল। এখন নতুন করে ঝুঁকি নিয়ে আর কেউ টেকনাফ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে চাইবেন না। ফলে আমাদের বিকল্প উৎস থেকে পণ্য আমদানির যে সুযোগ ছিল, সেটি হাতছাড়া হলো।”

মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এনে বিক্রি করে জারিফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর মােরশেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ছয় মাস পর বেশ ক’জন মিলে কিছু পণ্য আমদানি করতে গিয়েছিলেন। জাহাজগুলো ছিল বড় আর আসছিল ইয়াংগুন থেকে সাগর পথে চট্টগ্রামে। চারটি জাহাজে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার পণ্য ছিল।

সাধারণত মংডু থেকে আসা জাহাজগুলো থাকে ছোট এবং কাঠের তৈরি। এই জাহাজগুলো বড় হওয়ায় আরাকান আর্মির নজরে পড়ে যায় বলে মনে করেন তিনি।

“পরে অবশ্য তিনটি জাহাজ ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে এই, যে ভয় ঢুকল, সেটি তো সবার মাঝেই ছড়িয়েছে।”

জাহাজ ছাড়াতে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, “কত টাকা দিয়ে জাহাজ ছাড়া পেয়েছে, তা আমি জানি না।

“কিন্তু যদি টাকা দিয়ে জাহাজ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি স্থায়ী রূপ পায়, তাহলে কিন্তু সেই চাঁদা পণ্যের দামের সাথেই শেষ পর্যন্ত যোগ হবে। ফলে বাড়তি দামেই পণ্য কিনতে হবে ভোক্তাকে।”

কী চায় আরাকান আর্মি

মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৭০ কিলোমিটার নিজেদের কব্জায় নেওয়ার পর রাখাইনে আরাকান আর্মি মুলত সেদেশের সরকারের প্রতিপক্ষ হিসাবে স্বীকৃত।

সরকারি কোষাগার থেকে কোনও অর্থ তারা পাচ্ছে না। ফলে বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে তাদের চাই অর্থ। সেই কারণেই জাহাজ জিম্মি করে অর্থ আদায়ের কৌশল তারা নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

আটক জাহাজে থাকা পণ্যের দুই আমদানিকারক, এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চাঁদা দিয়ে জাহাজ ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নাম প্রকাশ না করে তারা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, মংডু থেকে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ থাকায় ইয়াংগুন থেকে আকিয়াব হয়ে পণ্য আনার উদ্যোগ তারা নিয়েছিলেন। কারণ সেই দুটি বন্দর এখনও আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

“ফলে আমরা একটা ঝুঁকি নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু জাহাজ বেশি বড় হওয়ায় তাদের নজর এড়াতে পারিনি,” বলেন একজন আমদানিকারক।

জাহাজ ছাড়াতে অর্থ কারা দিয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জাহাজগুলোর মালিক মিয়ানমারের। তারাই আরাকান আর্মিকে চাঁদা দিয়েছে। কিন্তু কত, সেটি জানায়নি। জাহাজ টেকনাফে পণ্য নামিয়ে ইয়াংগুন ফেরত যাওয়ার পর হয়ত আমরা জানব।”

আমদানিকারকরা বলছেন, এভাবে চাঁদা দিয়ে জাহাজ ছাড়াতে হলে প্রথমে জাহাজ মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। তার ওপর টেকনাফমুখী জাহাজে নাবিকরা উঠতে চাইবেন না। উঠলেও বাড়তি বেতন দিতে হবে। এভাবে পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে পণ্যের দামও যাবে বেড়ে। সেই সঙ্গে ঝুঁকিও থেকে যাবে।

আরাকান আর্মি কী চাইছে- প্রশ্নে এই ব্যবসায়ী বলেন, “মোটামুটিভাবে আরাকান আর্মি চায়, তাদের সাথে বোঝাপড়া এবং কমিশন দিয়েই যাতে নৌপথ ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা।”

আরাকান আর্মি সুযোগ পাচ্ছে কীভাবে

আপাতত মংডু থেকে নাফ নদী পথে টেকনাফে পণ্যবাহী জাহাজ আসা বন্ধ রয়েছে। ইয়াংগুন থেকে যে জাহাজগুলো আসছে, সেগুলো প্রথমে আকিয়াব (সিত্তে) বন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ শেষ করে টেকনাফে রওনা দেয়। এখন সেই জাহাজগুলোকেই ধরছে আরাকান আর্মি।

এই পথে পণ্য আমদানিকারী ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুটি কারণে আরাকান আর্মি ইয়াংগুন থেকে আসা জাহাজও আটকের সুযোগ পাচ্ছে।

একটি হচ্ছে, জাহাজগুলো আকিয়াব থেকে যাত্রা শুরু করে নাইক্ষংদিয়া এলাকায় (নাফ নদীর ওপারে সাগর মোহনায়) পৌঁছলে আটকে দিচ্ছে।

আরেকটি হচ্ছে, নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে গভীরতা বেশি থাকায় ওই পথেই জাহাজগুলো সাধারণত চলাচল করে। এতদিন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্যে কোনও বাধা আসেনি। এখন যেহেতু মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণ এই নাফ নদী এবং ২৭০ কিলোমিটার অংশে নেই, তাই আরাকানি আর্মি কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে।

টেকনাফ দিয়ে আমদানি কমেছে

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের টেকনাফ দিয়ে বাণিজ্য মূলত হয় নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের মংডু বন্দরের মাধ্যমে। মংডু থেকে ছোট ছোট কাঠের তৈরি জাহাজে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়।

আরাকান আর্মি মংডু বন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে টেকনাফ দিয়ে পণ্য আমদানিতে ধস নামে।

টেকনাফ স্থলবন্দরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে পণ্য আমদানি হয়েছে প্রায় ২ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সাড়ে ৭৮ হাজার টন, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ৬ মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র সাড়ে ২৩ হাজার টন।

আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যুদ্ধের শুরু থেকেই আমদানি কমতে শুরু করে। এখন নেমেছে ধস।

২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পণ্য আমদানি হয়েছিল সাড়ে ১২ হাজার টন, আগস্টে ২ হাজার ২৭৩ টন, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৬৪৭ টন, অক্টোবরে ১ হাজার ১৬৬ টন, নভেম্বরে ২ হাজার ২৯৬ টন এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে ৩ হাজার ৭২৪ টন।

মংডু থেকে পণ্য আমদানি পুরোপুরি বন্ধ থাকায় এখন আমদানি হচ্ছে ইয়াংগুন ও আকিয়াব বন্দর থেকে।

১৭ জানুয়ারি আরাকান আর্মির হাতে যে জাহাজগুলো আটক হয়, সেগুলো আসছিল ইয়াংগুন থেকে। নাফ নদীর মোহনায় মিয়ানমারের নাইক্ষংদিয়া এলাকায় দুটি জাহাজ পৌঁছলে তল্লাশির নামে আটকে দেয় আরাকান আর্মি। পরদিন আরও দুটি জাহাজ আটক হয় তাদের হাতে।

এসব জাহাজের মধ্যে আচার, শুঁটকি, সুপারি, কফিসহ ৫০ হাজারের বেশি বস্তা পণ্য ছিল। এগুলোর আমদানিকারক ছিলেন টেকনাফ স্থল বন্দরের ব্যবসায়ী শওকত আলী, ওমর ফারুক, মো. আয়াছ, এমএ হাসেম, মো. ওমর ওয়াহিদ, আবদুর শুক্কুর সাদ্দামসহ অনেকে।

টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আরাকান আর্মি কব্জায় সীমান্ত যাওয়ার পর মিয়ানমার থেকে পণ্য আনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।

“এখন চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে যদি পণ্যের দাম অন্য দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতামূলক না হয়, তাহলে ব্যবসা এখানে থাকবে না। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত