Beta
সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

নাম বদলাচ্ছে কারাগারের, চরিত্র কি বদলাবে

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
[publishpress_authors_box]

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’- এই স্লোগানে ‘বাংলাদেশ জেল’ চললেও তার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার মিল খুঁজে পাওয়াই ভার।

বিভিন্ন সময় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে ‘কারাগার হবে সংশোধনাগার’ কথাটি শোনা গেলেও তা আপ্তবাক্যই থেকে গেছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের যে হাওয়া লেগেছে, তার ঢেউ লেগেছে কারাগারেও।

মঙ্গলবার কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন কারা সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কারাগার বা বাংলাদেশ জেল-এর নাম পরিবর্তনের খবর জানান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ জেলের নাম পরিবর্তন করে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’ রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কারাগারকেন্দ্রিক সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপের জন্যই এই পদক্ষেপ- একথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার মোতাহের বলেন, এবিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।

গত ২৭ মে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, কারাগারকে সংশোধনাগার হিসাবে গড়ে তুলতে ব্যাপক সংস্কার করা হবে।

লাল দালানের ইতিহাস

অপরাধের জন্য আদালতে দোষি সাব্যস্ত হয় যারা, তাদের ঠিকানা হয় কারাগারে। একে ‘লাল দালান’ বলা হয়ে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।

সুপ্রাচীন কালে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ভারতীয় উপমহাদেশেও কারাগার ছিল, তবে ‘লাল দালান’ কথাটি প্রচলিত হয় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কারাগার থেকে।

কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এনিয়ে বলা রয়েছে, একদা এ জগতের সব অবকাঠামো লাল রঙয়ে মোড়া ছিল। সেখান থেকে লাল দালান কথাটির উৎপত্তি।

এই লাল দালান মানে বোঝানো হয়, চারপাশ ঘিরে ভারী উঁচু দেয়াল, মধ্যে লোহার গারদে আটক মানুষ।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসার পরই মূলত কারা ব্যবস্থাপনা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেতে থাকে। ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারের কাজ শুরু হয় ৷ ১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটক রাখতে ‘বেঙ্গল বিধি’ জারির পর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও কয়েকটি জেলা ও মহকুমা কারাগার নির্মিত হয়৷

১৯২৯ সালে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি, আলীপুর, মেদিনিপুর, ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হিসাবে ঘোষিত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৩টি জেলা কারাগার এবং ৪৩টি উপ-কারাগার নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ জেল (বিডিজে) যাত্রা শুরু করে।

পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে বন্দি সংখ্যা বেড়ে গেলে উপ-কারাগারগুলোকে জেলা কারাগারে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মোট ৭০টি কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল কাজ করে চলছে বলে তাদের ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়া আছে।

কারা মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে দুজন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও আটজন কারা উপ-মহাপরিদর্শকের সমন্বয়ে কারা বিভাগের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কারাগার পর্যায়ে প্রধান হিসাবে কাজ করেন জেল সুপার।

লক্ষ্য থেকে দূরে

বাংলাদেশ জেল তার স্লোগান রাখে- ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। তবে এই নিরাপদ কারাগারে যেমন জেল হত্যার মতো ঘটনা ঘটে, তেমনি কারাগারে যাওয়ার পর দণ্ডিতদে আরও অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার নজির ভুরি ভুরি।

অথচ বাংলাদেশ জেল-এর লক্ষ্যে বলা আছে, কারাগার আধুনিক সভ্যতায় বন্দিদের সংশোধন ও সুপ্রশিক্ষিত করে সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান।

“বিভিন্ন কারণে মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়তে পারে। আইন অনুসারে শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি তাকে সংশোধন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব বাংলাদেশ কারা বিভাগের।”

বাংলাদেশ জেলের লক্ষ্য দেশের কারাগারগুলোতে আগত বিপথগামী লোকদের সঠিক প্রেষণা দিয়ে তাদের কর্মের ভুল বুঝতে সহায়তা করা এবং সংশোধন করা। পাশাপাশি বর্তমান যুগের সথে তাল মিলিয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ হিসাবে তাদের সমাজে ফিরিয়ে দেওয়া।

তবে কারাগারে বন্দির চাপ বাংলাদেশ জেলের এই লক্ষ্য অর্জনকে অনেক দুরে ঠেলে দিচ্ছে বলে বহুবার কথা উঠেছে।

কারা অধিদপ্তরের কয়েক মাস আগের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭০টি কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪৩ হাজার হলেও রয়েছে ৭২ হাজার ১০৫ জন।

অর্থাৎ ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কারাগারগুলো। সবচেয়ে বেশি বন্দি রয়েছে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ৪ হাজার ৫৯০ জন ধারণ ক্ষমতার কারাগারটিতে বন্দি রয়েছে ৭ হাজার ৯৮৭ জন।

সবমিলিয়ে কারাগারে যত বন্দি রয়েছে, তার মধ্যে ১৮ হাজার ৪২৬ জন সাজাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেশি।

আদালতে মামলা জটের কারণে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমছে না বলে বিভিন্ন সময়ে বলা হচ্ছে।

কী পরিবর্তন আসছে

কারাগারকে সংশোধনাগার হিসাবে গড়ে তুলতে কী কী সংস্কার আসছে, গত ২৭ মে রাজশাহীর অনুষ্ঠানে সে সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেছিলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সংস্কারমুখী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আমরা এ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে আমরা কারাগারকে একটি সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।”

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, বন্দিকে অপরাধী নয়, সংশোধনযোগ্য মানুষ হিসেবে দেখা- এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার জন্যই সরকার ‘কারেকশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ তৈরিসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে বন্দিরা প্রশিক্ষিত হয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেলে বসেই আয়-রোজগারের সুবিধা পাবে এবং পরিবারকেও আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারবে।

অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক মানের কারা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, সেজন্য বন্দিদের নিরাপদ আটক নিশ্চিত করতে মোবাইল জ্যামার, পৃথক ইন্টারনেট সিস্টেম, বডিস্ক্যানার, লাগেজ স্ক্যানার, সার্কিট ডিটেক্টরসহ নানা ধরনের আধুনিক নিরাপত্তা সরমঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কারা অধিদপ্তরের চতুর্দশ ব্যাচের ডেপুটি জেলার এবং ৬২তম ব্যাচের কারারক্ষী ও নারী কারারক্ষীদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনীতে ওই অনুষ্ঠান হয়েছিল।

কারারক্ষীদের সাহসিকতা এবং কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ জেল মেডেল প্রবর্তনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া অবসরগামী কারা সদস্যদের আজীবন রেশন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত