Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

মাংস নিষিদ্ধ, কোরিয়ার কুকুরগুলোর এখন কী হবে

dogs
[publishpress_authors_box]

রেভারেন্ড জু ইয়ং বং মূলত একজন ধর্মপ্রচারক। এই কাজের বাইরে জীবিকার জন্য তিনি কুকুর পালন করেন মাংস বিক্রির জন্য। অবশ্য এখন আর তার এই ব্যবসা ভালো চলছে না। বরং এই কাজ এখন প্রায় অবৈধ হয়ে যাওয়ার পথে।

৬০ বছর বয়সী জু বিবিসিকে বলেন, “গত গ্রীষ্ম থেকেই আমরা কুকুর বিক্রি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পাইকাররা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। একজনও আসেনি।”

২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার একটি ঐতিহাসিক আইন পাস করে। এতে কুকুরের মাংস খাওয়ার জন্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছরের জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া আইনে বলা হয়, জু-এর মতো খামারিদের ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে বাকি কুকুরগুলো বিক্রি করে দিতে হবে।

তবে অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে অনেকের জীবিকার ভিত্তি হয়ে থাকা একটি শিল্প ধীরে ধীরে বন্ধ করার জন্য এই সময়টা যথেষ্ট নয়। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও খামারি ও খাঁচাবন্দি পাঁচ লক্ষাধিক কুকুরের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট সহায়তা পরিকল্পনা আসেনি।

এমনকি এই নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করা বিশেষজ্ঞ ও প্রাণী অধিকার কর্মীরাও বলছেন, এই আইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় অনেক সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কুকুরগুলোর জন্য নতুন বাসা খোঁজা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন অনেক কুকুরকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলা হবে।

এই ‘গ্রেস পিরিয়ডের’ মাঝামাঝি সময়ে এসে, কুকুর খামারিরা বহু কুকুর নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। কুকুরগুলো বিক্রি হচ্ছে না, খামার বন্ধ করা যাচ্ছে না। আর আয় না থাকায় খাবার জোটানোও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব এডিবল ডগসের সভাপতি জু বলেন, “মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। আমরা ঋণে ডুবে গেছি, শোধ করতে পারছি না। কেউ কেউ তো নতুন কাজও খুঁজে পাচ্ছে না। একেবারে অসহায় অবস্থা।”

বিপদ

চান-উর হাতে আছে মাত্র ১৮ মাস। এই সময়ের মধ্যেই তাকে ৬০০ কুকুর সরিয়ে ফেলতে হবে। না পারলে এই ৩৩ বছর বয়সী কুকুর মাংস খামারিকে দুই বছর পর্যন্ত জেল খাটতে পারেন।

তিনি বলেন, “বাস্তবতা হলো, শুধু আমার খামারেই যত কুকুর আছে, এই সময়ের মধ্যে আমি তাদের কিছুই করতে পারব না। আমি আমার সব সম্পদ এই খামারে ঢেলেছি—তারপরও কেউ কুকুর নিচ্ছে না।”

অথচ আগে পাইকার বা কসাইরা তার কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ছয়টি কুকুর কিনত।

প্রাণী অধিকার কর্মী এবং সরকারি কর্তৃপক্ষও কুকুরগুলোর জন্য কোনো বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিতে পারছেন না। সরকারি হিসাবে, এই অব্যবহৃত কুকুরের সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি।

চান-উ বলছেন, “তারা আইনটা পাস করেছে কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই। আর এখন বলছে যে তারা কুকুর নিতেও পারছে না।”

হিউম্যান ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিম্যালস কোরিয়ার (হক) প্রচার ব্যবস্থাপক লি সাংকিয়ংও এই উদ্বেগগুলোর সঙ্গে একমত।

তিনি বলেন, “কুকুরের মাংস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার এবং নাগরিক সমাজ বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে বাকি কুকুরগুলোকে রক্ষা করা যায়। একটি বড় ঘাটতি এখনও রয়েছে ফেলে যাওয়া কুকুরগুলোর বিষয়ে আলোচনা নিয়ে।”

কৃষি, খাদ্য ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক বিদেশি সংবাদ প্রতিনিধি বিবিসিকে বলেন, কোনও খামারি কুকুর ছাড়লে সেগুলোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার নেবে এবং সেগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখবে।

তবে এই কুকুরগুলোকে নতুন বাসা খুঁজে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ কুকুরের মাংস শিল্পে ওজনই লাভের মাপকাঠি। ফলে খামারগুলো সাধারণত বড় আকৃতির জাতগুলোই পছন্দ করে। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ার শহুরে সমাজে (অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস) সম্ভাব্য পোষ্যপ্রেমীরা সাধারণত ছোট আকৃতির কুকুরই চান।

লি সাংকিয়ং বলেন, মাংসের খামার থেকে আসা কুকুরদের নিয়ে সামাজিক কুসংস্কারও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এসব কুকুর হয়তো রোগ বা মানসিক আঘাত নিয়ে এসেছে। বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে, কারণ অনেক কুকুরই হয় খাঁটি বা মিশ্র তোসা-ইনু জাতের। এই জাতটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত এবং পোষ্য হিসেবে পালতে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে কুকুর উদ্ধারকেন্দ্রে আগে থেকেই জায়গার অভাব। এসব প্রতিবন্ধকতা একত্রে এক ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক কুকুর, যাদের ‘উদ্ধার’ করা হয়েছে বলে ভাবা হচ্ছিল, এখন তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এদের অনেককেই হয়তো শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হবে।

চান-উ বলেন, “এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। যেসব সংগঠনের দাবির ভিত্তিতে এই আইন তৈরি হয়েছে, আমি ধরে নিয়েছিলাম, তারা নিশ্চয়ই কুকুরগুলোর জন্যও কোনও সমাধান ভেবেছে—যেমন তারা হয়তো নিজ দায়িত্বে কুকুরগুলোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখন শুনছি, তারাই বলছে কুকুর মেরে ফেলা ছাড়া আর উপায় নেই।”

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কোরিয়ান অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান চো হি-কিয়ং স্বীকার করেন, “আমরা যতটা সম্ভব কুকুর উদ্ধারের চেষ্টা করব। কিন্তু কিছু কুকুর থেকে যাবে। বাকি কুকুরগুলো ‘বেওয়ারিশ ও পরিত্যক্ত প্রাণী’ হয়ে হেলে সেটা হৃদয়বিদারক। কিন্তু সেগুলোকেও হত্যা করতে হবে।”

এই উদ্বেগ প্রশমিত করতে সরকার কয়েক সপ্তাহ পর ঘোষণা দেয়, প্রাণী হত্যা করা নিশ্চিতভাবেই তাদের পরিকল্পনার অংশ নয়।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার কৃষি, খাদ্য ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিবিসিকে জানায়, তারা প্রতিবছর প্রায় ৬ বিলিয়ন কোরিয়ান ওন বিনিয়োগ করছে প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্র সম্প্রসারণে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায়। সেই সঙ্গে যারা আগেভাগেই ব্যবসা বন্ধ করবে, তাদের প্রতিটি কুকুরের জন্য ৬ লক্ষ কোরিয়ান ওন পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়া হবে।

তবে হক জানায়, তারা কৃষি, খাদ্য ও গ্রামীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি জোরালোভাবে অনুরোধ করেছে, যেন কুকুর উদ্ধারের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ফেজ-আউট প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

হক আরও জানায়, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার কুকুর মাংস খামার থেকে তারা প্রায় ২ হাজার ৮০০ কুকুর পুনর্বাসন করেছে। কিন্তু কুকুরকে পুনর্বাসনের পুরো দায়িত্ব শুধু প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

সিওল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভেটেরিনারি মেডিকেল এডুকেশন অফিসের পরিচালক চুন মিয়ং-সানও মনে করেন, সরকারের পরিকল্পনায় ফেলে রাখা কুকুরদের বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তা করা হয়নি।

তিনি বলেন, “এই কুকুরগুলোকে কীভাবে ‘ব্যবস্থা’ করা হবে, তা নিয়ে একটি পরিষ্কার আলোচনা হওয়া জরুরি। নিষ্ঠুর কসাইখানার হাত থেকে কুকুরগুলোকে উদ্ধারের চেষ্টা করেও যদি শেষ পর্যন্ত তাদেরই মেরে ফেলতে হয়, তাহলে মানুষের কষ্ট পাওয়া ও ক্ষোভে ফেটে পড়া একেবারে স্বাভাবিক।”

জীবিকার ভাঙন

কেউ কেউ সমাধান খুঁজেছেন দেশের বাইরেও। তারা কুকুরগুলোকে পাঠিয়েছেন এমন সব দেশে, যেখানে মানুষ এগুলোকে দত্তক নিতে আগ্রহী—যেমন কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

২০২৩ সালে হক নামের সংগঠনের একটি দল আসান শহরের একটি খামার থেকে প্রায় ২০০টি কুকুর উদ্ধার করে। পরে সেগুলো পাঠানো হয় কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে।

ওই খামারের সাবেক মালিক ইয়াং জং-তায়ে বিবিসিকে বলেন, তিনি যখন দেখছিলেন কীভাবে উদ্ধারকারীরা কুকুরগুলো ট্রাকে তুলে নিচ্ছেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন তাদের মমতা দেখে।

তিনি বলেন, “ওরা যেভাবে কুকুরগুলোকে ধরে ট্রাকে তুলছিল—একেবারে মানুষের মতো, আলতো ও যত্ন নিয়ে—তা দেখে আমি খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।

“আমরা ওদের এভাবে দেখি না। আমাদের কাছে কুকুর পালন শুধুই জীবিকার উপায় ছিল। কিন্তু ওই সংগঠনের লোকেরা কুকুরগুলোকে একজন সম্মানিত ব্যক্তির মতো আচরণ করছিল। এটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।”

তবে ইয়াং জং স্পষ্ট করে জানান, তিনি কুকুরের মাংস উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞার বিরোধী।

তিনি বলেন, “কুকুর শুধু প্রাণী হওয়ার কারণে নিষিদ্ধ হলে গরু, শুকর কিংবা মুরগি খাওয়াটা কেন ঠিক? সব তো এক জিনিস। প্রকৃতিতে এসব জিনিস মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আছে।”

কিন্তু অনেকের মতে, কুকুরের মাংস খাওয়াকে অন্য প্রাণীর মাংস খাওয়ার সঙ্গে এক করে দেখা যায় না। তারা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে কুকুরের মাংস বেশি বিপজ্জনক। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায়, যেখানে কুকুরের মাংস কখনোই কোনও নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে ছিল না।

হিউম্যানি ওয়ার্ল্ড ফর অ্যানিমেলস জানায়, দক্ষিণ কোরিয়ার বাইরে চীন, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের কিছু অঞ্চলেও কুকুরের মাংস খাওয়া হয়।

তবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে কুকুরের মাংস খাওয়ার হার উঠানামা করলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি ক্রমেই সামাজিকভাবে বর্জনীয় হয়ে উঠছে।

২০২৪ সালের এক সরকারি জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে তারা গত এক বছরে কুকুরের মাংস খেয়েছে। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ শতাংশ। জরিপে আরও দেখা যায়, মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ বলেছে তারা ২০২৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেতে থাকবে। আর মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বলেছে তারা নিষেধাজ্ঞার পরেও খাওয়া চালিয়ে যাবে।

নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসার পর দক্ষিণ কোরিয়ার ১ হাজার ৫৩৭টি কুকুর খামারের মধ্যে ৬২৩টি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

সিওল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভেটেরিনারি মেডিকেল এডুকেশন অফিসের পরিচালক চুন মিয়ং-সান বলেন, “সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ফলে এখন দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কুকুরের মাংস উৎপাদন আর চলবে না।”

তবুও অনেকের জন্য এটি এমন একটি শিল্প, যার ওপর তারা তাদের গোটা জীবন দাঁড় করিয়েছেন।

বিবিসিকে কুকুর মাংস ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, জীবিকা হারিয়ে তারা কীভাবে নিজেদের জীবন চালাবেন, সেই ব্যাপারে তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।

অনেকে বলছেন, তারা এখন দারিদ্র্যকেই ভবিষ্যৎ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। তারা জানাচ্ছেন, তারা কোরিয়ান যুদ্ধের সময় জন্মেছিলেন, আর ক্ষুধা নিয়ে বাঁচতে জানেন। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এই ব্যবসা হয়তো এখন গোপনে চলতে পারে।

তবে অনেকেই একমত যে, তরুণ খামারিদের জন্য পরিস্থিতি আরও বেশি উদ্বেগজনক।

রেভারেন্ড জু ইয়ং বং বলেন, “এই শিল্পে তরুণরা একেবারেই অন্ধকার ভবিষ্যতের মুখে। তারা কুকুর বিক্রি করতে পারছে না। আবার দ্রুত ব্যবসা গুটাতেও পারছে না। তারা মাঝখানে আটকে গেছে, সামনে এগোনোরও উপায় নেই, পেছনে ফেরারও উপায় নেই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত