ছয় বছর পর কারামুক্ত খালেদা জিয়া যখন চার মাস আগে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলেন, তখন তার ফিরে আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখছিলেন কেউ কেউ। তারেক রহমানের ফিরে না আসার মধ্যে তার যাওয়ায় নানা গুঞ্জন ভাসছিল।
সেই গুঞ্জনে অবসান ঘটল বিএনপি চেয়ারপারসনের ফিরে আসার মধ্যদিয়ে। দিনটিকে শুধু বিএনপির জন্যই নয়, দেশের জনগণের জন্যই উল্লেখযোগ্য দিন বলে মনে করছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কারণে সমর্থকদের কাছে আপসহীন নেত্রী হিসাবে পরিচিত খালেদা জিয়ার এই ফেরা তার দল বিএনপির পাশাপাশি দেশের রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান।
অভ্যুত্থান পরবর্তী এই অস্থির সময়ে খালেদা জিয়ার এই ফেরা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি বদলে দেবে বলে মনে করেন প্রবাসী সাংবাদিক-কলামনিস্ট মারুফ মল্লিক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে কারাবন্দি হন।
দুই বছর পর কোভিড মহামারির সময় সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে ঘরে থাকার সুযোগ দিলেও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
নানা রোগে আক্রান্ত ৭৯ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার এই সময় লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে, হৃদযন্ত্রে স্টেন্টও বসাতে হয়েছিল। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা না পেলে তার জীবন সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কার কথা বলছিল বিএনপি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি তার দণ্ড মওকুফ করলেও তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে দুটি মামলার দায় থেকে মুক্ত হন।
আগস্টের পর বিএনপি নেতারা বলছিলেন, চিকিৎসার জন্য এখন খালেদা জিয়া বিদেশ যাবেন, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বিভিন্ন মামলায় দণ্ড নিয়ে লন্ডনে থাকা তার ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।
কিন্তু তা ঘটছিল না বলে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়। মুক্তি পাওয়ার পাঁচ মাস পর গত ৮ জানুয়ারি খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান।
তাতে পাঁচ দশক পর বাংলাদেশে একই সময় দুই নেত্রীর অনুপস্থিতি দেখা যায়। কারণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে গত আগস্টেই পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এই দুই নেত্রীকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা হয়েছিল। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও সেই ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ প্রয়োগের আশঙ্কা করেন কেউ কেউ; যদিও সরকারের তরফে সেই ধরনের কোনও চেষ্টা নেই বলে জানানো হয়।
খালেদা জিয়ার ফিরে আসা সেই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হলো মন্তব্য করে মারুফ মল্লিক ফেইসবুকে লিখেছেন, “যারা মাইনাস টু এর গল্প ফেঁদেছিলেন, তারা হতাশ হবেন। আর যারা বিএনপিকে ঠেকিয়ে দেওয়ার আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন, তারাও হতাশ হবেন।”
খালেদা জিয়া বিদেশ যাওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকার এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের সঙ্গে তার দল বিএনপির নানা প্রশ্নে বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তিনি যাওয়ার পর সেই বিরোধ আরও বাড়ে।
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা এরই মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তারা সংস্কারের আগে জাতীয় নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, দাবি করেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার।
বিএনপির এক সময়ের জোটসঙ্গী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিভিন্ন প্রশ্নে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নৈকট্য দেখা যাচ্ছে। জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে মুখরোচক আলোচনার খোরাক জোগায়।
বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাড়া না পেয়ে ক্ষোভও জানায়। অন্তর্বর্তী সরকার যখন সংস্কারে জোর দিতে চাইছে, তখন বিএনপি নির্বাচন দ্রুত দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর ওপর জোর দিচ্ছে।
এই অবস্থায় খালেদা জিয়া দেশে ফেরার গুরুত্ব সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন মঙ্গলবার সকালে নেত্রীর জন্য ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অপেক্ষারত মির্জা ফখরুল।
বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের সামনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটা আমাদের জন্য, গোটা জাতির জন্য একটি আনন্দের দিন। আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের যে সময়, এই সময়ে তার উপস্থিতি আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিন।
“আমরা মনে করি, খালেদা জিয়ার উপস্থিতি, তার ফিরে আসা আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে আরও সহজ করবে। দেশকে একটি সঠিক ও বৈষম্যহীন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।”
বিএনপি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বলতে বোঝাচ্ছে, নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবসান এবং নির্বাচিত সংসদরে মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের অধিষ্ঠান।
সেই নির্বাচন কবে হবে, তার কোনও সুস্পষ্ট রোডম্যাপ এখনও না পাওয়ায় বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিলেও বিএনপি চায় স্পষ্ট ঘোষণা, চায় রোডম্যাপ ধরে নির্বাচনের কাজ শুরু হোক।
ফখরুল কথা বলার ঘণ্টা দুয়েক পরে বিমানবন্দরে নামেন খালেদা জিয়া। কাতারের আমিরের পাঠানো একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে চার মাস আগে বিদেশ গিয়েছিলেন তিনি, ফিরেছেন সেই আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সেই।
হুইলচেয়ারে বসা খালেদা জিয়া যখন ভিভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে বেরিয়ে আসেন, তখন তার চোখের তারার ঔজ্জ্বল্য রোদ চশমার আড়াল থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। তার সঙ্গে আসা দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান ও শর্মিলা রহমান সিঁথির চোখে-মুখেও ছিল খুশির ঝলক।
প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা মাঝে-মধ্যে দেশে এলেও তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান স্বামীর সঙ্গে ২০০৮ সালে লন্ডন পাড়ি জমানোর পর এই প্রথম দেশে ফিরলেন। এই সময়ে সরকারি চাকরিটিও হারাতে হয় ডা. জোবাইদাকে।
বিমানবন্দরে ফখরুলসহ নেতা-কর্মীরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান খালেদা জিয়াকে। তারপর গুলশানের বাড়ি ফিরোজায় রওনা হন খালেদা। বরাবরের মতোই গাড়ির সামনে চালকের পাশের আসনটি নেন বিএনপি চেয়ারপারসন, পেছনের আসনে বসেন দুই পুত্রবধূ।
এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি মহাসচিব সড়কে ভিড় না বাড়াতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান রেখেছিলেন। তবে দলটির কর্মী-সমর্থকদের মিছিল সকাল থেকেই ছুটতে থাকে বিমানবন্দরের দিকে, তাদের প্রিয় নেত্রীকে একবার দেখার আশায়।
বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানে চড়ে বিএনপির সমর্থকদের ঢল নামে বিমানবন্দর থেকে বনানী হয়ে গুলশান পর্যন্ত। কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কারও হাতে দলীয় পতাকা, কারও হাতে প্ল্যাকার্ড। দেড় দশককাল দুঃসময়েও দলের সঙ্গে থাকা তাদের মুখে স্লোগান- ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই-রাজপথ ছাড়ি নাই’।
বিমানবন্দর থেকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় উচ্ছ্বসিত হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকের মিছিলে। শুভেচ্ছা বিনিময়ের সেই ভিড় ঠেলে ঠেলে গুলশানের বাসার ১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে খালেদা জিয়ার লেগে যায় দুই ঘণ্টা।
খালেদা জিয়ার প্রতি এই সমর্থনকে বিএনপির শক্তি হিসাবে দেখিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “দেশনেত্রীর আগমন আমাদের জন্য শুধু আবেগ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক শক্তির প্রকাশ।”
খালেদা জিয়ার ফেরার দিকটি নিয়ে নিজের সংবাদপত্রে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, “খালেদা জিয়াকেই দলের ঐক্যের প্রতীক ভাবা হয়। দলে সবার মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করতে তিনিই পারেন।”
সামগ্রিক রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “ক্ষমতায় যেতে হলে গণমানুষের সমর্থন দরকার। আর সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়া একটি দৃষ্টান্ত। তিনি একমাত্র নেত্রী যে কোনও নির্বাচনে হারেননি। ক্ষমতার বাইরে, এমনকি সংসদের বাইরে থেকেও তিনি রাজনৈতিক ভূমিকা রেখেছেন।”
গত শতকের ৮০ এর দশকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে রাজনীতির কঠিন পরিবেশে নেমে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তুলে মারুফ মল্লিক লিখেছেন, “খালেদা জিয়া তার নিজস্ব নেতৃত্বগুণের কারণে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছেন। খালেদা জিয়ার রাজনীতি, কৌশল ও নেতৃত্ব বিস্তারিত গবেষণা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।”
অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অভিঘাতে দেশের রাজনীতি যখন সঙ্কটাপন্ন, তখন মারুফ বলছেন, “আমার ধারণা, খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর রাজনীতি অনেকটা বদলে যাবে।”
খালেদা জিয়া ফিরলেও ছেলে তারেক রহমান ফেরেননি। লন্ডনে মায়ের চিকিৎসার তদারকির পর সোমবার রাতে নিজে গাড়ি চালিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে মাকে পৌঁছে দেন তারেক। সেখানেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেন তিনি।
অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই মামলাগুলোর দায় থেকে মুক্ত হয়েছেন তারেক, যেগুলোতে তার দণ্ড হয়েছিল। ফলে দলের ভবিষ্যতের কাণ্ডারীর ফেরার অপেক্ষায় আছেন বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা।
কিন্তু এবারও হতাশ হতে হয়েছে তাদের। কেন তারেক আসছেন না, সেই প্রশ্ন তাদের জানা নেই। দলটির নেতারা শুধু বলছেন, তারেক রহমানের ফেরার পরিবেশ এখনও হয়নি। এর বেশি কিছু স্পষ্ট করছেন না তারাও।
তারেক না ফিরলেও তার স্ত্রী, যিনি রাজনীতিতে অনাগ্রহী বরাবরই, সেই জোবাইদার দেশে ফেরা বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে অভ্যর্থনা জানানোর মিছিলে এই প্রথম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের পাশাপাশি জোবাইদার ছবিও দেখা গেল।
তাহলে তারেকের অনুপস্থিতিতে কি জোবাইদা বিএনপিতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে এলেন? সেই প্রশ্নও উঠছে।
এনিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, “তারেক রহমান যদি দেশে ফেরেন, তাহলে মনে হয় না জোবাইদা রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন।”
যেহেতু খালেদা জিয়া এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন, সেক্ষেত্রে জোবায়দা তার সহকারীর ভূমিকায় থাকতে পারেন বলে মনে করেন সোহরাব হাসান।