‘গাজা জ্বলছে’- ইসরায়েলি বাহিনী স্থল অভিযান শুরুর পর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ তার সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে একথাটি লিখলেন। তেল আবিবে সুরক্ষিত স্থানে বসে তিনি জ্বলার কথা বলেছেন, কিন্তু তাতে পুড়তে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা-বিরোধিতার মধ্যেই ইসরায়েল মঙ্গলবার গাজা শহরে বিস্তৃত স্থল হামলা শুরু করেছে। লাগাতার বোমা হামলার মুখে নিজেদের সবচেয়ে বড় শহর থেকে এখন পালানোর পথ খুঁজছে ফিলিস্তিনিরা।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই স্থল অভিযান শহরের উপকণ্ঠে শুরু হয়েছে, যেখানে গত এক সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চািলয়ে অনেক ভবন ধসিয়ে দিয়েছিল।
ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের ভেতর যে দুটি অংশ নিয়ে ফিলিস্তিন, তার পশ্চিম অংশটি হলো গাজা। ভূমধ্য সাগর তীরের ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত গাজার ২০ লাখের বেশি বাসিন্দার ৯৯ শতাংশই মুসলমান।
এই গাজার উত্তর অংশে গাজা সিটি; ইসরায়েলি বাহিনী তার নিয়ন্ত্রণ নিতেই অভিযান শুরু করেছে। এই এলাকায় হামাসের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, যে দলটি ইসরায়েলের অভিযান প্রতিরোধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
দুই বছর ধরে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পর গত আগস্টের শুরুতে গাজা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা অনুমোদন দেয় দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা।
মঙ্গলবার স্থল অভিযান শুরুর পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গাজা ‘জ্বালিয়ে’ দেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামোতে’ হামলা চালাচ্ছে এবং জিম্মিদের মুক্তি ও হামাসকে পরাজিত করতে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজা শহরে আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধটি মোড় ঘোরানোর একটি অবস্থায় পৌঁছেছে। কারণ তার সরকার এটিকে হামাসের শেষ দুর্গ মনে করে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থা সতর্ক করে আসছে, এই অভিযান গাজার চরম মানবিক সঙ্কট আরও নাজুক করে তুলবে।
সেখানে কিছু অংশে এরই মধ্যে দুর্ভিক্ষ চলছে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, গাজা শহর ও এর আশেপাশে বাস করে।
ইসরায়েল স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আইডিএফ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ শতাংশ মানুষকে সরানো গেছে।
আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং দেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের উদ্বেগ উপেক্ষা করেই নেতানিয়াহু এই অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি তার বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্তে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। তারা বলেছে, আক্রান্ত এলাকার বেসামরিক নাগরিকদের শুধু ফিলিস্তিনি হওয়ার কারণে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
তবে ইসরায়েল এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটা ‘বিকৃত ও মিথ্যা’। এই তদন্ত কমিশন বাতিল করতে হবে।
প্রায় দুই বছরের যুদ্ধে রাফা এবং খান ইউনিসের মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোর মতো পরিণতি থেকে গাজা শহর অনেকটা রক্ষা পেলেও এখন এটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের তথ্যানুসারে, মঙ্গলবার শুধু উত্তর গাজাতেই অন্তত ৯৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয় এবং পুরো এলাকায় নিহতের সংখ্যা ১০০ জনের বেশি।
এক রাতের তীব্র বিমান হামলায় আতঙ্কিত গাজা শহরের বাসিন্দারা তাদের অবশিষ্ট জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভিডিওতে শহরের শেখ রাদওয়ান এলাকার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর দেখা গেছে, যার কিছু সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে ব্যাগ ও কম্বল নিয়ে ছুটছে। তাদের মাথার ওপর উড়ছে ইসরায়েলি ড্রোন।
গাজা শহরের বাসিন্দা মাইসার আল আদওয়ান মাথার উপর তোশক ও কম্বল বহন করছিলেন, তার মুখ দিয়ে ঘাম ঝরছিল। তিনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি।
আল আদওয়ান বলেন, “ভয়, শুধু ভয়। সারাদিন আমাদের মাথার ওপর বিস্ফোরণ হচ্ছিল।”
ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার আগস্টের শুরুর দিকে অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজা শহরে আক্রমণ কেবল তখনই শুরু হওয়ার কথা ছিল, যখন ফিলিস্তিনিদের আল-মাওয়াসি এলাকায় সরে যেতে বাধ্য করা হবে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বিতর্কিত গাজা মানবিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্র ১৬টি স্থানে সম্প্রসারিত করার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র পাঁচটি চালু আছে, যার কারণে ফিলিস্তিনিদের জরুরি খাদ্য ও সাহায্যের জন্য প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতে হয়।
চার সন্তানের মা রাওয়ান আল সালমোনি গাজা শহরের একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের কাছে ফুটপাতে তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বসেছিলেন। তিনি বলেন, বারবার স্থানান্তরের কারণে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রতিবারই বোমা বর্ষণের পর মনে হয় এই বুঝি তিনি মারা যাবেন।
আল সালমোনি বলেন, “আমরা যে সেখান থেকে বের হতে পেরেছি, তা একটা অলৌকিক ঘটনা।”
মধ্য ও উত্তর গাজায় ফিলিস্তিনিরা যা কিছু নিতে পেরেছে তা নিয়ে নিরাপদে আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যাচ্ছে। আল-রশিদ স্ট্রিটের উপকূলীয় মহাসড়কে ভিড় এতটাই ছিল যে গাড়ি প্রায় নড়তেই পারছিল না।
সালাহ আল-দিন রোডে একটি পিকআপ ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে আহমাদ আবুল-হাল বলেন, “আপনারা কি ভাবছেন আমরা পিকনিকে যাচ্ছি! আমরা ধ্বংস এবং ধ্বংসাবশেষ থেকে পালাচ্ছি। কিন্তু আমরা মৃত্যু থেকে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি, এটা এমন নয় যে আমরা মৃত্যু থেকে গৌরবের দিকে যাচ্ছি।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গাজা শহরে ইসরায়েলের আক্রমণ প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।
তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “এটি একেবারেই স্পষ্ট যে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে এবং তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। গোটা বিশ্বকে সরব হতে হবে। যা ঘটছে, তা চূড়ান্ত অর্থে অগ্রহণযোগ্য।”
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফও সতর্ক করেছে যে সামরিক অভিযানের তীব্রতা শিশুদের দুর্ভোগ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে, সুরক্ষার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নেবে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই অভিযান বন্ধে বৈশ্বিক হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদিনাহ এক বিবৃতিতে বলেন, “পুরো বিশ্ব এই অভিযান প্রত্যাখ্যান করেছে, এটিকে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে। এটা এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াবে ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।”
কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে, যা ইসরায়েল এই নতুন অভিযান শুরু করার ঘোষণার ঠিক তখনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর জেরুজালেম সফরের মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয়েছে।
সোমবার রুবিও হামাসের কাছে গাজায় অবশিষ্ট ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে এবং ক্ষমতা ছেড়ে দিতে দাবি জানান; যদিও তিনি স্বীকার করেন যে এমন কিছু হয়ত ঘটবে না।
নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রুবিও সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের (হামাস) নির্মূল করার জন্য শেষ পর্যন্ত একটি সুসংহত সামরিক অভিযান প্রয়োজন হতে পারে।”
এদিকে হামাস গাজা শহরের এই অভিযানকে ‘বর্বর জায়নবাদী আক্রমণ’ আখ্যায়িত করে বলেছে, এটা সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন লঙ্ঘন করেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা মঙ্গলবার জানিয়েছেন, গাজা শহরে প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার হামাস যোদ্ধা থাকতে পারে বলে তাদের অনুমান।
তিনি বলেন, “আমরা গাজা শহরে ২ থেকে ৩ হাজার হামাস সন্ত্রাসীর সাথে যুদ্ধ করছি। কিন্তু যারা দক্ষিণে চলে যাচ্ছে, সেই ফিলিস্তিনিদের ভিড়ে এই হামাস সদস্যদের মিশে যাওয়া ঠেকানোর কোনও সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেই।”
ফলে আরও অভিযান সামনে আসতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “গাজা শহর বর্তমানে হামাসের প্রধান দুর্গ। আমি প্রধান বলেছি, শেষ নয়।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন