আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় বিঘ্নিত হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের যাবতীয় কাজকে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা’ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এই ঘোষণার ফলে আন্দোলন এনবিআর কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনিভাবেই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো এবং তা নেওয়া হবে বলেই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণির চাকরিকে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা (Essential Services)’ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ফেইসবুক পাতায় এক পোস্টে এই ঘোষণা জানানোর পাশাপাশি এনবিআরকর্মীদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
তাতে বলা হয়, “আমরা আশা করি, অনতিবিলম্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক নানা সংস্কারে হাত দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর আওতায় সরকারের রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে আলাদা দুটি বিভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গত মে মাসে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ নামে আন্দোলনে নামে সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, এর মধ্যদিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে।
তাদের কর্মবিরতিতে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ওই অধ্যাদেশ সংশোধনের আশ্বাস দিলে বাজেটের আগে কর্মসূচি স্থগিত করে কাজে ফেরে আন্দোলনকারীরা।
এরপর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হলে পুনরায় আন্দোলনে ফেরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। তাদের আগের দাবির সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানকে অপসারণের দাবিও যুক্ত হয়।
শনিবার পরিষদের ডাকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি শুরুর পরদিনই কঠোর বার্তা দিয়ে এনবিআরের কাজকে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা’ ঘোষণা করল।
আইনে আছে কী
সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় ধর্মঘট কিংবা আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ২০২৩ সালে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন’টি প্রণয়ন করে।
এই আইন প্রণয়নের সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ সেবা; ডিজিটাল আর্থিক সেবা; স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ ও আকাশ পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ সেবা; হাসপাতাল সেবা; খাদ্য কেনা, সরবরাহ, মজুদ সম্পর্কিত সেবাসহ ১৮ ধরনের সেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা ঘোষণা করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত পরিষেবা এই ১৮টির মধ্যে থাকলেও রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত সেবা তার মধ্যে ছিল না।
আইনে সরকারকে এই ক্ষমতা দেওয়া ছিল যে ভবিষ্যতে সরকার চাইলে যেকোনো পরিষেবাকে এই আইনের অধীন করতে পারবে। সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করে এখন এনবিআর সেবাকেও এই আইনের আওতায় আনল অন্তর্বর্তী সরকার।
এই আইনের অধীনে অত্যাবশ্যক পরিষেবা সংশ্লিষ্ট সংস্থায় ধর্মঘট করা যাবে না। কেউ তা করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার।
শাস্তি কী
এই আইনে বলা আছে, কেউ নির্দেশ অমান্য করে এককভাবে কিংবা সংঘবদ্ধ হয়ে যৌথভাবে কাজ না করলে, আদেশ অমান্য করতে অন্য কাউকে প্ররোচিত করলে, যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাজে অনুপস্থিত থাকলে শাস্তি হবে অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
কেউ বেআইনি ধর্মঘট শুরু করলে, অংশগ্রহণ করলে এবং তাতে কাউকে প্ররোচিত করলে আইনে তার শাস্তি ছয় মাস কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
কেউ ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ দিলে, চাঁদা দিলে তাও অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। তার শাস্তি অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
এর পাশাপাশি বেআইনি ধর্মঘটের জন্য সংস্থার নিয়ম বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও রয়েছে এই আইনে।
বাংলাদেশের শ্রম আইনে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট ডাকতে হলে ইউনিয়নের ৫১ শতাংশ সদস্যের সমর্থন থাকতে হয়। তা নাহলে ওই ধর্মঘট সরকারের দৃষ্টিতে হয় বেআইনি।
বদলির পর এবার দুদকের জাল
এনবিআরে আন্দোলন শুরুর পর পাঁচ উপ-কর কমিশনারকে গত রবিবার আকস্মিকভাবে বদলি করা হয়। তাদেরকে দুদিনের মধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতেও বলা হয়।
তারা হলেন- শাহ্ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী, মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ ইউসুফ, ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিল ও নুশরাত জাহান শর্মী।
এবার এনবিআরের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছি যে এই কর্মকর্তারা কর ফাঁকিতে সহায়তা করেছেন এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছেন।”
এই ছয় কর্মকর্তার সবাই আন্দোলনরত এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতা। তারা হলেন- পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার (অতিরিক্ত কমিশনার, অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিরেক্টরেট, ভ্যাট, ঢাকা), এ কে এম বদিউল আলম (সদস্য, আয়কর নীতি), মির্জা আশিক রানা (অতিরিক্ত কর কমিশনার, কর অঞ্চল-৮, ঢাকা), মোহাম্মদ মোর্শেদ উদ্দিন খান (যুগ্ম কর কমিশনার, বিসিএস ট্যাক্স একাডেমি), মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা (উপ-কর কমিশনার, কর অঞ্চল-১৬, ঢাকা) এবং সাধন কুমার কুণ্ডু (অতিরিক্ত কমিশনার, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ)।
এর আগে যে পাঁচজনকে বদলির ক্ষেত্রে আন্দোলনই কারণ ছিল বলে অভিযোগ তোলে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।
দুদকের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তা কারণ কি না- প্রশ্নে আক্তার হোসেন বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে এই তদন্তের কোনও সম্পর্ক নেই। এই ছয়জন ছাড়াও যদি এনবিআরের অন্য কারও বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ আসে, তাও দুদক খতিয়ে দেখবে।
পাল্টাপাল্টি অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিতে এনবিআরে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, “সরকার গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, রাজস্ব সংস্কারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ নজিরবিহীনভাবে গত ২ মাস ধরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে ব্যাহত করে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে, যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।
“এই তথাকথিত আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক, যা জাতীয় স্বার্থ ও নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থি।”
সরকারের পক্ষ থেকে দাবি বিবেচনায় নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া না দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার।
“আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে।”
অন্যদিকে শনিবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ শুরুর দিন ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার বলেন, দেশের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি। তবে তার আগে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে অপসারণ করতে হবে।
অচলাবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, “দেশ ও রাজস্বের স্বার্থে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রম ও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের যৌক্তিকতা জানাতে যেকোনো সময় অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ সর্বদা প্রস্তুত।
“কিন্তু আমাদের এ ধরনের আহ্বান সত্ত্বেও অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর থেকে আজ পর্যন্ত আলোচনার জন্য কোনও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে এনবিআর সংস্কার নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছি আমরা।”
আলোচনার উদ্যোগ না নেওয়ার বদলে পাঁচ কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে রিকাবদার বলেন, “কর্মসূচিতে সম্মুখসারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন পাঁচ আয়কর কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে অপেক্ষাকৃত কম রাজস্ব সম্ভাবনাময় দপ্তরে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। এমনকি আদেশে প্রাপ্য যোগদানকাল না দিয়েই পরবর্তী কর্মদিবসে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগদান করতে বলা হয়, যা চাকরিবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও অবৈধ।
“এই অবৈধ আদেশ এনবিআর চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ। যৌক্তিক কর্মসূচিতে থাকা কর্মকর্তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে উস্কে দিয়ে তিনি পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চান। তার এই কর্মকাণ্ড অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক।”