রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হত্যামামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশ রিমান্ডে গেলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম।
তার আগে আদালতে ওকালতনামায় স্বাক্ষর না করে টিপসই দেন তিনি; এজলাসে যতক্ষণ ছিলেন কেঁদে কেঁদেই পার করেন পুরোটা সময়।
মদিনা গ্রুপের কর্ণধার ব্যবসায়ী হাজি সেলিম এক সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার ছিলেন। ১৯৯৬ সালে পুরান ঢাকার লালবাগ আসন (তখন ছিল ঢাকা-৮, এখন ঢাকা-৭) থেকে প্রথম আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এরপর ২০১৪ সালে একই আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ২০১৮ সালে আবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর এবছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ওই আসনে তার ছেলে সোলায়মান সেলিম আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই আন্দোলনে এক কলেজ ছাত্র নিহতের ঘটনায় করা মামলায় রবিবার রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে হাজি সেলিমকে। পরদিন সোমবার দুপুর সাড়ে ৩ টার কিছু আগে তাকে আদালতে হাজির করা হয়।
পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় নেওয়ার পর প্রথমে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয় হাজি সেলিমকে। সাড়ে ৩টার পর তাকে তোলা হয় এজলাসে।
সেখানে উঠে অঝোরে কাঁদতে থাকেন হাজি সেলিম। বার বার চোখ মুচছিলেন তিনি, হাতে ইশারায় কাউকে কিছু বলতে চাইছিলেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে হাজি সেলিম অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি রহিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রচারে নেমে তাকে ভাঙা ভাঙা শব্দে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল।
আদালতে বিচারক আসন নিলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই আক্কাস মিয়া আসামি হাজি সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন হেফাজতে রাখার আবেদন করেন।
তখন হাজি সেলিমের আইনজীবী প্রাণনাথ আদালতের অনুমতি নিয়ে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে চান। আদালত অনুমতি দিলে আইনজীবী যান হাজি সেলিমের কাছে।
তবে সাবেক এই সংসদ সদস্য স্বাক্ষর করতে পারেন না বলে জানান। পরে তার টিপ সই নিয়ে আদালতে তার পক্ষে ওকালতনামা দাখিল করেন প্রাণনাথ।
মদিনা গ্রুপের কর্ণধার হাজি সেলিম সংসদ সদস্য হিসাবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা নবম শ্রেণী বলে উল্লেখ করতেন।
আদালতে শুনানিতে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান আদালত পুলিশের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। বিএনপি সমর্থক আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকীও রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে শুনানিতে অংশ নেন।
বিপরীতে হাজি সেলিমের আইনজীবী প্রাণনাথ শুনানিতে বলেন, “এটা হত্যা মামলা। জমি দখল, মার্কেট দখলের সাথে এ মামলার কোনও সম্পর্ক নেই।”
আদালতে উপস্থিত বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা তখন সমন্বরে বলতে থাকেন- সম্পর্ক আছে।
এরপর প্রাণনাথ বলেন, “এজাহারে সুস্পষ্ট বলা আছে, লালবাগের ডিসির নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। রিমান্ডে নিলে ডিসিকে নিতে হবে। তাকে কেন?”
তখনও বিএনপির আইনজীবীরা চেঁচামেচি করতে থাকেন। এরমধ্যেই মহানগর হাকিম মো. আক্তারুজ্জামানের হাজি সেলিমের পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।
শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে, সেই আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর অবস্থানে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়।
সরকার পতনের পর নিহতের ঘটনাগুলো নিয়ে সারাদেশেই মামলা হচ্ছে, যেগুলোতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেকমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের আসামি করা হচ্ছে।
ঢাকার আইডিয়াল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র খালিদ হাসান সাইফুল্লাহ নিহতের ঘটনায় তার বাবা কামরুল হাসান ১৯ আগস্ট লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
গত ১৮ জুলাই লালবাগের আজিমপুর সরকারি আবাসিক এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান খালিদ হাসান।
তার দুদিন আগে ১৬ জুলাই ধানমণ্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসক দেখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন হাজি সেলিম।
২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন হাজি সেলিম। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে তার ১৩ বছর কারাদণ্ডও হয়েছিল। সেই দফায় তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন।
২০২২ সালে ওই মামলায় হাইকোর্ট হাজি সেলিমের ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে রায় দিলে ফের কারাগারে যেতে হয়েছিল তাকে। কয়েকমাস পর আবার জামিনে ছাড়া পান।