মূল্যস্ফীতির পারদ খানিকটা বেড়েছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
আগের মাস আগস্টে অর্থাৎ অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাসে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক কমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছিল, যা ছিল ৩৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল দেশে। এরপর আর কখনও ৮ শতাংশের নিচে নামেনি।
অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল দেশে।
গত অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।
টানা কয়েক মাস কমে গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে আসে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে কিছুটা বেড়েছিল; আগস্টে আবার নিম্মমুখী হয়। সেপ্টেম্বরে ফের বেড়েছে।
সেপ্টেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মানে হল, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১০৮ টাকা ৩৬ পয়সা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় খাতের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যম্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ; আগস্টে হয়েছিল ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশে উঠেছে।
মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছুদিন ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়ে এগোচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট বা রেপো রেট) ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
গত ৩১ আগস্ট ঘোষিত চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি যতদিন ৭ শতাংশের নিচে না নামবে, ততদিন নীতি সুদহার কমবে না বলে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় পরিষ্কার জানিয়ে দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো এক দিনের জন্য টাকা ধার নেয়। একে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদহার বা রেপো রেট। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে।
রেপোর সুদ বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর তহবিল পাওয়ার খরচ আরও বাড়ে। তাতে ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সুদহার বেড়ে যায়।
এই হার অপারিবর্তিত রাখার মানে হলো, বাজারে মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত সুদহারের লাগাম শিথিল করছে না।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির লাগামা টেনে ধরতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে; কোনও কোনও পণ্যের শুল্ক শূন্য করেছে।
গতবছর জুলাই মাসে আন্দোলনের ধাক্কায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের কয়েক মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করছিল।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ০৫ শতাংশে নেমে আসে। জুনে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
সেপ্টেম্বর শেষে (২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর) দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি
সেপ্টেম্বরেও শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে এই মাসে গ্রামীণ এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ।
আগের মাস আগস্টে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে দেশের শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ।
আগস্টে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
মজুরি সূচক কমেছে
মানুষের আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে মাসে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৮ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি।
আগের মাস আগস্টে মজুরি হার ছিল এর চেয়ে বেশি, ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। জুলাইয়ে আরও বেশি ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ।
গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস। মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে।
বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছর ধরে মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে ৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশে ওঠে।
এভাবে প্রতি মাসেই অল্প অল্প করে বেড়ে গত অক্টোবরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে ৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ হয়। নভেম্বরে আরও কিছুটা বেড়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ হয়। ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই সূচক ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ১৫, ৮ দশমিক ১৯, ৮ দশমিক ২১ ও ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য বলছে, গত তিন মাস ধরেই মজুরি সূচক কমছে।