বিক্ষোভের মুখে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রি রাজোয়েলিনা বর্তমানে একটি অজ্ঞাত স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। সোমবার অনলাইনে প্রকাশিত এক ভাষণে তিনি নিজেই বিষয়টি জানিয়েছেন। টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের পর আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের এই দরিদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটি এখন সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।
প্রেসিডেন্টের ওই ঘোষণা ছিল খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত মাদাগাস্কারের সাম্প্রতিক অস্থিরতার নতুন অধ্যায়।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফরাসি সামরিক বিমানে দেশ ত্যাগের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার প্রস্থান এই বছরের তৃতীয় সরকার পতনের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলো।
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, মাদাগাস্কারের পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা সিতেনি র্যান্ড্রিয়ানাসোলোনিয়াইকা নিশ্চিত করেছেন যে সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর রাজোয়েলিনা রবিবার দেশ ছেড়েছেন।

তিনি বলেন, “আমরা প্রেসিডেন্টের দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা নিশ্চিত করেছেন যে তিনি দেশত্যাগ করেছেন।” রাজোয়েলিনার বর্তমান অবস্থান এখনও অজানা।
তবে দেশটির সামরিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট রবিবার ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি সিএএসএ বিমানে মাদাগাস্কার ত্যাগ করেছেন। ফরাসি রেডিও সংস্থা আরএফআই জানিয়েছে, এই সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপটি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে হওয়া এক সমঝোতার পর সম্পন্ন হয়।
গাজা যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত এক সম্মেলনের পর মিসর থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, রাজোয়েলিনার দেশত্যাগে ফ্রান্সের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবেন না। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “মাদাগাস্কারে সাংবিধানিক শৃঙ্খলা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, ফ্রান্স মাদাগাস্কারের তরুণদের ক্ষোভ ও দাবি-দাওয়াকে স্বীকার করে। তবে সেই ক্ষোভ যেন সামরিক শক্তির মাধ্যমে অপব্যবহার না হয়।
সামরিক সূত্র অনুযায়ী, উদ্ধার অভিযানটি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। একটি ফরাসি সিএএসএ বিমান সেন্ট মেরি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি হেলিকপ্টার রাজোয়েলিনাকে সেই বিমানে স্থানান্তর করে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার সরকারকে বিদ্যুৎ ও পানির মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। মাদাগাস্কারের নিরাপত্তা বাহিনী প্রথমে সহিংসভাবে বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করেছিল। পরে তারাই তরুণদের নেতৃত্বে চলা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঘোষণা করে যে তারা আর তাদের ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ মানবে না।
সোমবার রাজধানী আন্তানানারিভোতে প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা জাতীয় ভাষণ দেবেন বলে যখন সবাই অপেক্ষা করছিল, তখন শহরজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। অধিকাংশ মানুষই ধরে নিয়েছিল যে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন।
শহরের কেন্দ্রস্থলে বিক্ষোভের মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সিটি হলের সামনে মে ১৩ স্কয়ারে হাজারো মানুষ জড়ো হয়। সেখানে ফল, গ্রিল করা মাংস ও আইসক্রিম বিক্রেতাদের ভিড় ছিল।
বিক্ষোভকারীরা মাদাগাস্কারের জাতীয় পতাকা নাড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিল এবং গান গাইছিল। এর মধ্যে একটি গানে অশালীন শব্দ ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার পদত্যাগ দাবি করা হয়। মঞ্চের পাশে ঝুলছিল একটি বড় ব্যানার, যাতে ছিল অ্যানিমে স্টাইলে তৈরি “খুলি ও হাড়ের” চিহ্ন। এখন বিশ্বজুড়ে জেন জেড প্রজন্মের প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে এই চিহ্ন। ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের নেতারা বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে উদ্দীপ্ত করছিলেন।
শনিবার পুলিশের গুলিতে নিহত এক বিক্ষোভকারীর কফিন যখন একটি ভ্যানের ছাদে করে স্কয়ারের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পুরো ভিড় নিস্তব্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ শ্রদ্ধা জানিয়ে হাত উঁচু করে।
২৯ বছর বয়সী আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফেনোসোয়া হনিত্রিনিয়াইনা বলেন, “আমি খুশি ও আত্মবিশ্বাসী যে মাদাগাস্কারের ভবিষ্যৎ আরও ভালো হবে।”
৫১ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। যদিও সপ্তাহান্তে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রবিবার তার অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, যখন দেশের এলিট আধা-সামরিক বাহিনী ‘জঁদার্ম’ এর উচ্চপদস্থ সদস্যরা এক ভিডিও বার্তায় জানান যে তারা বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করছেন।
রবিবার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার নিযুক্ত নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক সেনা জেনারেল রুফিন ফর্চুনাত জাফিসাম্বো বলেন, তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
তিনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে পাঠানো এক টেক্সট বার্তায় লেখেন, “আমি প্রথমেই একজন সৈনিক। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয় হলো আমার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা। আমাদের একটাই মিল, আমরা আমাদের দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসি। আমি এখনও সেই ব্যাপারে আশাবাদী।”

মাদাগাস্কারে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় আগে। তখন সরকার নিয়মিত বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মতো বৃহত্তর ইস্যুগুলোর প্রতিবাদে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাদাগাস্কারের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার বেশিরভাগই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চরম খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট বন্যা দেশের কৃষি উৎপাদনকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
অনেক বিক্ষোভকারী জানিয়েছেন, তারা আর প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার ওপর আস্থা রাখেন না যে তিনি দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবেন।
রাজোয়েলিনা তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০০৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। তিনি ২০১৩ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। কিন্তু ২০১৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফেরেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। যদিও তার বিরোধীরা দাবি করে যে সেই নির্বাচন ছিল কারচুপিপূর্ণ।
তিনি নিজে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসরেও সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন যে, আরেকটি অভ্যুত্থান দেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
এই মাসের শুরুতে তিনি তার পুরো মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করেন। তিনি দাবি করেন বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই পদক্ষেপ বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। আর তার পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো হয়।
বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে, মাদাগাস্কারের নিরাপত্তা বাহিনী ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত প্রায় দুই ডজন মানুষ নিহত হয়েছে। যদিও সরকার সেই সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে।
বিক্ষোভ কেন
মাদাগাস্কারের রাজধানী আন্তানানারিভোর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ কেন বিক্ষোভে নেমেছে, তা বুঝতে হলে শহরের উপর ঝুলে থাকা কেবল কারটির দিকে তাকালেই যথেষ্ট। ফ্রান্সের অর্থায়নে এ বছর সম্পন্ন হওয়া এই কেবল কার লাইনটির উদ্দেশ্য ছিল যানজট কমানো। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এটি সচরাচর চালু থাকে না।
বিদ্যুৎ যখন থাকে, তখনও অল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য এক ইউরো সমমূল্যের ভাড়া নেওয়া হয়। এটি বাসভাড়ার ছয়গুণ এবং মাদাগাস্কারের অনেক মানুষের এক দিনের খাবারের চেয়েও বেশি। দেশটির এক সরকারি কর্মকর্তার ভাষ্যে, “এটি এখন এক ধরনের বিনোদনমূলক দর্শনীয় জায়গা হয়ে গেছে, পরিবহন ব্যবস্থা নয়।”
গত ১৫ বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বড় যে বিক্ষোভ হয়েছে, তাতে বেশ কয়েকটি কেবল কার স্টেশন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা আর সহ্য করতে পারছেন না অবিরাম বিদ্যুৎ বিভ্রাট, পানি সংকট এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতি।
তারা প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রি রাজোয়েলিনার পদত্যাগ দাবি করেছেন। এই নেতা একসময় ছিলেন একজন ডিজে এবং পরে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ভেষজ ওষুধ প্রচার করে আলোচিত হন।
বিক্ষোভকারীদের আরেক লক্ষ্য মামী রাভাতোমাঙ্গা নামের একজন ব্যবসায়ী। তাকে তারা “পর্দার আড়ালের প্রকৃত ক্ষমতাবান” হিসেবে দেখছেন।

এই তরুণ বিক্ষোভকারীরা নিজেদের আফ্রিকা ও এশিয়ার অন্যান্য প্রতিবাদ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম মনে করছেন। কেউ কেউ কেনিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনের উদাহরণ টানছেন, আবার কেউ কেউ সেই “পাইরেট পতাকা” ওড়াচ্ছেন যা সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া ও নেপালের তরুণ আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছে।
কিন্তু তাদের ক্ষোভের মূল উৎস দেশীয়, মাদাগাস্কারের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা। ১৯৬০ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর থেকে দেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। যুদ্ধবিহীন কোনও দেশের জন্য এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পতন। এই বিক্ষোভ চালাচ্ছে জেনারেশন জেড প্রজন্ম। কিন্তু তাদের অভিযোগ জমে উঠেছে বহু দশকের অবহেলা ও শোষণের ফলে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে, মাদাগাস্কারের দারিদ্র্যের কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। দেশের বেশিরভাগ শ্রমিকই জীবিকার জন্য নিজস্ব কৃষিকাজে নির্ভরশীল। তাদের উৎপাদনশীলতা ও আয় “ক্রমাগত নিম্নগামী,” বলছে বিশ্বব্যাংক। এর একটি কারণ হলো খরা ও বন উজাড়ের কারণে মাটির গুণগত মানের অবনতি।
একজন কূটনীতিকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে দেশের জনসংখ্যা যেখানে ছিল ৫০ লাখ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখে। কিন্তু বনভূমির পরিমাণ ৩৩ মিলিয়ন হেক্টর থেকে কমে ৬ মিলিয়নে নেমে এসেছে।
মাদাগাস্কারের কোনও গ্রামে যেতে হলে শুধু প্রধান সড়ক থেকে কয়েক মাইল পাড়ি দিতে হয় না। বরং মনে হয় যেন সময়েরও পেছনে ফিরে যাচ্ছেন। গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে চলছে, মাঝে মাঝে পানির কলসি হাতে হাঁটা কিশোরীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
দ্য ইকোনোমিস্টের করা এক অনানুষ্ঠানিক জরিপে দেখা গেছে, অনেক মাদাগাস্কারবাসী প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনেরই নাম শোনেননি। বর্তমান প্রবৃদ্ধির হারে, রুয়ান্ডা ও উগান্ডার জীবনযাত্রার মানে পৌঁছাতে মাদাগাস্কারকে আরও ৭০ বছরের বেশি সময় লাগবে।
মৌলিক অবকাঠামোর অবস্থা ভয়াবহ। বর্তমানে ১৯৬০ সালের তুলনায় পাকা সড়কের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। দেশের উত্তরে সাম্প্রতিক এক সফরে দেখা গেছে, দুটি শুকনো নদীর পাড় গাড়ি চালিয়ে পার হতে হয়েছে। কারণ সেতুগুলো অকেজো হয়ে আছে। আন্তানানারিভো থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরের বন্দরে (তামাতাভে) পণ্য পরিবহনের খরচ এত বেশি যে সেই পণ্য পরে ফ্রান্সে পাঠাতে কম খরচ হয়।
গ্রামীণ দারিদ্র্যের অবনতি এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শহরমুখী মানুষের ঢল নেমেছে, বিশেষত রাজধানীতে। এতে পুরনো বিদ্যুৎ, পানি ও আবাসন ব্যবস্থার ওপর চাপ আরও বেড়েছে। আন্তানানারিভোর প্রান্তে এখন ধানক্ষেতের ওপর তৈরি হচ্ছে “ভাসমান বস্তি” অর্থাৎ পানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা টিনের ঘর।
মাদাগাস্কারের সমস্যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৩ (এবং পরবর্তীতে ১৯৯৭ থেকে ২০০২) সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট দিদিয়ের রাতসিরাকার শাসনামলে চালু হওয়া সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোর ব্যর্থতা থেকে। সিআইএ তখন তাকে সন্দেহ করেছিল যে, তিনি দেশটিকে “আফ্রিকার উত্তর কোরিয়া” বানাতে চান। আন্তানানারিভোর একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “কিন্তু সমস্যা কেবল অর্থনীতির নয়।”
আন্তানানারিভো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেনি আলেক্সান্দ্রে লাহিনিরিকোর মতে, মাদাগাস্কার দুটি বড় কাজে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, দেশটি প্রায় ২০টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সাধারণ জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে পারেনি। তাদের একাংশের শিকড় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং অন্য অংশের আফ্রিকান উপকূলে। দ্বিতীয়ত, দেশটি এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি যা সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করবে, কেবল ধনী অভিজাত শ্রেণির নয়।
একজন সরকারি কর্মচারী বলেন, দুর্নীতি এতটাই নিয়মিত বিষয় হয়ে গেছে যে, চীন বা অন্যান্য আফ্রিকান দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকার খাম ফিরিয়ে দেওয়া তার নিত্যদিনের ব্যাপার। এক রাজনীতিক বলেন, “যদি আমি আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য সুযোগ-সুবিধা না জোগাড় করি, তারা আমাকে ত্যাগ করবে।”
দুর্নীতিবিরোধী কর্মী কেতাকান্দ্রিয়ানা রাফিতসন বলেন, “আমরা এক মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি।” মাদাগাস্কারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি এক অর্থে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কারণ এর কোনও শেষ নেই। সোনা, লিচু, ভ্যানিলা, রোজউড, কচ্ছপ কিংবা দেশীয় লেমুর সবকিছুই দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বিদেশি ক্রেতাদের চুক্তির মাধ্যমে পাচার করা যায়।
২০২৩ সালে ব্রিটেনের একটি আদালত প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনার সাবেক চিফ অব স্টাফকে এক রত্নখনি কোম্পানির কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। স্থানীয় একজন বিশ্লেষকের মতে, “এটি আসলে এক ‘ধনসম্পদে ভরা দ্বীপ,’ যেটি জলদস্যুদের হাতে লুণ্ঠিত।”

দারিদ্র্যের এমন গভীরতায় অনেক দর্শনার্থী অবাক হন, কেন মাদাগাস্কারবাসীরা এতদিন ধরে এই অবস্থায় জীবনযাপন মেনে নিয়েছেন। একটি কারণ নিঃসন্দেহে হলো ক্ষমতাধরদের বিরুদ্ধে কথা বললে দমন-পীড়নের ভয়। তবে আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, অনেক মাদাগাস্কারবাসী পার্থিব জীবনের চেয়ে পরজীবনে বেশি বিশ্বাস রাখেন।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে দেখা যায়, মানুষ নিজেদের ঘরের চেয়ে কবরের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করে এবং মৃত্যুর পর জেবু গরু কোরবানি দেয়। স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, “তাদের ধারণা হলো, তুমি জীবিত অবস্থায় যত দরিদ্রই হও না কেন, মৃত্যুর পর মর্যাদা পেতে পারো।”
দেশের মধ্যাঞ্চলে “ফামাদিহানা” নামে পরিচিত এক প্রথা প্রচলিত আছে, যার অর্থ “হাড় ঘোরানো।” এই আচার অনুযায়ী, মৃতদেহ কবরে থেকে তুলে আনা হয় এবং প্রাচীন পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্ট করতে ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এসব ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান প্রায়ই পরিবারের সামান্য সঞ্চয় শেষ করে ফেলে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই প্রথাগুলো দারিদ্র্যের কারণ নয় বরং তার ফলাফল। বর্তমান যে বিক্ষোভ সরকারের পতন করেছে, তা প্রমাণ করে মাদাগাস্কারবাসীরা প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে জানেন। ২০০৯ সালে তৎকালীন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানার বিরুদ্ধে বিক্ষোভই শেষ পর্যন্ত এক সামরিক অভ্যুত্থানের জন্ম দেয়, যা প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনাকে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য ট্রিবিউন, সিএনএন।



