Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট, ২০২৫

রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে যেভাবে এল মঙ্গল শোভাযাত্রা

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে থাকছে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী বনরুই। চারুকলায় চলছে তা নির্মাণের প্রস্তুতি। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় গুরুত্ব নিয়ে থাকছে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী বনরুই। চারুকলায় চলছে তা নির্মাণের প্রস্তুতি। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।
[publishpress_authors_box]

১৯৮৯ সাল, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সেই আন্দোলনে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছিলেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক। কিছুটা সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করেন।

সেবারই প্রথম পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বের হয় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। এরশাদের পতনের পর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই পরিচিত হয় তা। আর এই শোভাযাত্রা এখন নগরে বাংলা নববর্ষ বরণের অন্যতম অনুসঙ্গ।

বর্তমানে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন তখন ছিলেন একজন তরুণ শিক্ষক। শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছিল। তার বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারাই মূলত এই আয়োজনটি করেছিল। এই শোভাযাত্রা তখন থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী এবং মৌলবাদবিরোধী।” 

২০১৬ সালে চারুকলার এই শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য চারুকলার শিক্ষার্থীদের তৈরি করা মুখোশ। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

শুরুটা যেভাবে

গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করেছিল, বাঙালির আত্মপরিচয় মেলে ধরতে তখন রমনায় ছায়ানটের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠান।

ঠিক ওই সময় বৈশাখ নিয়েও একটি শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল বলে জানান অধ্যাপক নিসার। ওই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই সময়কার ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর জিএস মতিয়া চৌধুরী।

নিসার হোসেন বলেন, “৬০ দশকের মাঝামাঝি সময় মতিয়া চৌধুরী প্রথম একটি শোভাযাত্রা করে। সেখানেও শিল্পীদের আকা নানান ছবি ব্যানার নিয়ে শোভাযাত্রাটি হয়। শোভাযাত্রার মূল ব্যানারে লেখা ছিল- এসো হে বৈশাখ।”

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় শিল্পী জয়নুল আবেদিনও নববর্ষ উদযাপনে কর্মসূচি নিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

“গণঅভ্যুত্থানের সময় জয়নুল আবেদিন স্যার শিল্পীদের একত্রিত করছিলেন। সে সময় নবান্ন উৎসবসহ নানা ধরনের আয়োজন হচ্ছিল। তখন আমাদের শোনা, নববর্ষ পালনেও কর্মসূচি করা হয়েছিল।”

চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে যশোরের এমনই এক আয়োজন। ১৯৮৫ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন এ ধরনের একটি শোভাযাত্রা শুরু করে পহেলা বৈশাখে।

অধ্যাপক নিসার বলেন, “ওইটা ওই এলাকার ডিসি করতেন। দুই বছর হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওইটার নাম ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা।”

এরপর ১৯৮৮ সালের বন্যায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান ডুবে যায়। তখন চারুকলার শিক্ষার্থীরা কেরানীগঞ্জ এলাকার বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কাজ করে। সেই থেকে একসঙ্গে মিলে কাজ করার অনুপ্রেরণা এই শিক্ষার্থীরা পায়। সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন উপলক্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীরা একটি শোভাযাত্রা করে।

১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে বেরিয়েছিল এই আনন্দ শোভাযাত্রা।

এরপর যশোরের আদলে পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা বের করার পরিকল্পনা চারুকলার শিক্ষার্থীরা নেয় বলে অধ্যাপক নিসার জানান।

তিনি বলেন, “সেই সময় ছায়ানট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ওয়াহিদুল হক, শিল্পী ইমদাদ হোসেন, রফিকুন নবী স্যার তাদেরকে বলেন, যশোরে ওরা তো বৈশাখ মাসে একটি উৎসব হিসাবে করে। যেহেতু জেলা প্রশাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় এটা হয়, ফলে ওইখানে রাজনৈতিক কিছু রাখা যায় না। আমরা ছায়ানট আন্দোলন থেকে শুরু করে যা করেছি, তার মধ্যে একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক হিসাব মাথায় রেখে করেছি। তোমরা যদি করতে চাও, সেই জিনিস মাথায় রেখে করতে হবে। দেশে এখন যা হচ্ছে তাকে এড্রেস করে কর।”

সেই কথায় উজ্জীবিত হয়ে শোভাযাত্রার পরিকল্পনা শুরু হয়। স্বৈরাচারকে দেখানোর জন্য একটি ঝাড়ু বানানোরও পরিকল্পনা হয়। শোভাযাত্রার স্লোগান ঠিক করা হয়- দূর হোক সকল অকল্যাণ, গাহি মঙ্গলের জয়গান।”

শেষ পর্যন্ত সেইবার ঝাড়ুটা বানানো হয়নি। সেই প্রসঙ্গে অধ্যাপক নিসার হোসেন একটু হেসে বলেন, “চারুকলায় শিক্ষার্থীরা সেবার সাহস পায়নি শেষ পর্যন্ত এই ঝাড়ু বানানোর। কিন্তু পরের বার যখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর সাথে যুক্ত হয়। তখন ঝাড়ু প্রদর্শন করে শোভাযাত্রাটি হয়।”

আনন্দ শোভাযাত্রা নামে শুরু হয়ে কীভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পেল- জানতে চাইলে অধ্যাপক নিসার বলেন, নামটা মঙ্গল শোভাযাত্রাই দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে এর ভুল ব্যখ্যা হতে পারে, এই আশঙ্কায় আনুষ্ঠানিকভাবে নামটি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেই পরিচিতি পায়।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার এবারের নববর্ষ উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যসচিব।

মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য বানানো মুখোশে শেষ সময়ে তুলির আঁচড় দিচ্ছেন চারুকলার এক শিক্ষার্থী। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

৩৬ এ পা

মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার ৩৬ বছরে পা রাখছে। প্রতিবছরের মতো এবারও রবিবার ১৪৩১ সালের প্রথম দিনের সকালে বাদ্যযন্ত্রের তালে নানা ধরনের বাঁশ-কাগজের তৈরি ভাস্কর্য, মুখোশ হাতে বের হবে বর্ণাঢ্য এই মিছিল।

এবারের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে তিন দিনের অনুষ্ঠান হবে। চারুকলার বকুলতলায় ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় হবে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান।

‘আমরা তো তিমির বিনাশী’ প্রতিপাদ্য নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হবে পয়লা বৈশাখ সকাল ৯টায়। এবার শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় ঘুরে বারডেমের পাশ দিয়ে, শিশু একাডেমির সামনের মোড় ঘুরে আবার শাহবাগ দিয়ে টিএসসি হয়ে চারুকলার সামনে শেষ হবে।

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় বড় আকারের প্রতীকগুলো তৈরি করা হয়েছে লোকসংস্কৃতির উপকরণ ও দেশের বিপন্ন প্রাণীদের নিয়ে। এর মধ্যে থাকবে একটি হাতি, বনরুই, গন্ধগোকুল, টেপাপুতুল, চাকা ইত্যাদি। এছাড়া থাকবে বড় আকারে রাজা-রানির দুটি মুখোশ। ছোট আকারে হাতে বহন করার মতো ফুল, প্যাঁচা, পাখির মুখোশ থাকবে শতাধিক।

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় বকুলতলায় মঞ্চস্থ হবে বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের জীবনভিত্তিক যাত্রাপালা ‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’। পালা লিখেছেন শান্তিরঞ্জন দে। নির্দেশনা দিয়েছেন সেতু খান। যাত্রাপালায় অভিনয় করবেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।

প্রতি বছরই মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতীক হিসাবে স্থান পায় নানা প্রাণী। ফাইল ছবি

বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী বনরুই এবারের শোভাযাত্রার নতুন সংযোজন। এর মাধ্যমে প্রকৃতিকে ফিরে পাওয়ার আহ্বান থাকবে শোভাযাত্রায়। গত বছরও বিলুপ্তপ্রায় নীল গাই ছিল শোভাযাত্রায়।

এবারের শোভাযাত্রায় বনরুই নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন চারুকলা অনুষদের ছাত্র শিমূল কুম্ভকার। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এক সময় গ্রামে প্রায়ই বনরুই প্রাণীটি দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এই প্রাণীটি আর দেখা যায় না। আমরা আমাদের শোভাযাত্রায় এরকম বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াগুলো প্রাণীকে তুলে ধরতে চাই।

“আমাদের আশে পাশে এরকম বিভিন্ন প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা একটু খেয়াল করলেই হয়ত এরা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচত। আমরা এই বার্তাটাও এবারের শোভাযাত্রা থেকে দিতে চাই।”

অন্যান্য প্রতীক বাছাইয়ের পেছনে গ্রাম বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে বলে জানান শিমুল।

“আমরা যেসব প্রতীক বানাই, সেগুলো সবই কিন্তু এক সময় মেলায় পুতুল আকারে পাওয়া যেত। আমাদের কুমাররা তাদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এসব শিল্পকর্ম বানাতেন। এখন সেই রকম মেলাও হয় না, সেখানে এসব দেখাও যায় না। আমরা শুধু সেইসব শিল্প মানুষকে মনে রাখাতে চাই।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত