Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫

বিমান দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ নেপালের আদালতের, ‘জানে না’ ইউএস-বাংলা

UuuS_Bangla
[publishpress_authors_box]

২০১৮ সালের মার্চে কাঠমান্ডুর বিমানবন্দরে নামার সময় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত আরোহীদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে নির্দেশ দিয়েছে নেপালের একটি জেলা আদালত। গত ২২ জুলাই কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে কাঠমান্ডুর ওই জেলা আদালতের রায়কে ঐতিহাসিক বলা হয়েছে।

অবশ্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস গতকাল শনিবার জানিয়েছে, নেপালের কোনও আদালত এ ধরনের কোনও রায় দেয়নি। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ডেইলি স্টারকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি নেপালের কোনও আদালত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের রায় দেয়নি।

ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ মনে করে, আদালতের কোনও অনুলিপি ছাড়া অন্য একটি দেশের জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে কোনও সংবাদ পরিবেশন করা সমীচীন হবে না।

এ বিষয়ে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইউএস-বাংলার ওয়েবসাইট ও তাদের সোশাল মিডিয়া পেইজে কোনও বক্তব্য বা বিবৃতি পাওয়া যায়নি।

কাঠমান্ডু জেলা আদালতের আদেশ অনুযায়ী, বিমা দাবির আওতায় প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া ২০ হাজার ডলারের বাইরেও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে ১৭টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মোট ২৭ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে।

নেপালের বিমান চলাচলের ইতিহাসে এটিই প্রথম ঘটনা যেখানে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার এত বড় একটি মামলায় জয়লাভ করল। গত সাত দশকে নেপালে ৭০টি বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় ৯৬৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ছিল মারাত্মক অবহেলার ফল।

তবুও এর আগে কোনও এয়ারলাইন্স সংস্থাকে দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হয়নি। ফলে এই রায় সেই ধারাবাহিকতায় বড় পরিবর্তন।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার অধিকার রাখে। তবে গত রবিবারের এই রায় ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে মনে করছে কাঠমান্ডু পোস্ট। এই রায় আরোহী বা তাদের পরিবারকে ইচ্ছাকৃত গাফিলতি বা মারাত্মক অবহেলার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতিপূরণের দাবি জানানোর আইনি অধিকার দিচ্ছে।

কাঠমান্ডু জেলা আদালতের তথ্য কর্মকর্তা দীপক কুমার শ্রেষ্ঠা জানিয়েছেন, রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশে কিছুটা সময় লাগতে পারে।

বিচারক দিবাকর ভট্টের আদালতে ১৬ জন নিহত যাত্রীর পরিবার ও এক জীবিত যাত্রী মামলাটি করেছিলেন।

সংবাদমাধ্যম ‘দ্য পোস্ট’ দাবি করেছে, তাদের কাছে আদালতের রায়ের কপি আছে। সেই কপি অনুসারে, সাতজন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর (আশনা শাক্য, অঞ্জিলা শ্রেষ্ঠা, মেলি মহারজন, নিগা মহারজন, প্রিন্সি ধামি, সঞ্জয় মহারজন ও শ্রেয়া ঝাঁ) প্রত্যেকের পরিবারকে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৮২ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

তাদের পরিবার ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই আদালতে ভুল চিকিৎসা ও মৃত্যুর দায়ে সীমাহীন ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন। এই ক্ষতিপূরণের বাইরে রয়েছে বিমা দাবির ২০ হাজার ডলার।

ছয়জন এমবিবিএস শিক্ষার্থীর আরেক দলের (শ্বেতা থাপা, সঞ্জয় পাউডেল, পূর্ণিমা লোহানি, অঙ্গিলা বরাল, চারু বরাল ও সরুনা শ্রেষ্ঠা) প্রত্যেকে পাবেন ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪১৮ ডলার।

হিমালয়া এয়ারলাইন্সের কর্মী প্রসন্ন পাণ্ডের পরিবারকে ১ লাখ ৭ হাজার ১৭০ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়েছে আদালত। নিউরোসার্জন ডা. বলকৃষ্ণ থাপার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৮ ডলার। ৬৭ বছর বয়সী নার্স গ্যানি কুমারি গুরুংয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার ৩০১ ডলার।

আর বেঁচে যাওয়া যাত্রী ডা. সামিরা বিয়ান্জনকার পাবেন ৪৪ হাজার ২৯০ ডলার। এসব অর্থও বিমা দাবির বাইরের।

দুর্ঘটনার সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মোট বিমা কভারেজ ছিল ১০৭ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭ মিলিয়ন ছিল বিমানের জন্য এবং ১০০ মিলিয়ন ছিল আরোহীদের জন্য। এই বিমা কভারেজ দিয়েছিল বাংলাদেশি দুটি সংস্থা, সেনা কল্যাণ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।

প্রাথমিকভাবে অনেক পরিবার ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে মামলায় না গিয়ে সমঝোতায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

আদালতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইসিএও এর অ্যানেক্স ১৩ অনুসারে তৈরি দুর্ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদনগুলো সরাসরি আইনগত দোষারোপের জন্য প্রযোজ্য নয় এবং প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয় না। তবুও চূড়ান্ত রায়ে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের পদ্ধতি ও দায় প্রমাণের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা থাকবে।

রায়ে আর্থিক, শারীরিক, মানবিক ও মানসিক দিক বিবেচনায় ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আদালতের মতে, এয়ারলাইন্সের ইচ্ছাকৃত গাফিলতি ও পাইলটের মানসিক অস্থিরতা, এই দুইয়ের সম্মিলিত কারণে একটি সচল বিমানের দুর্ঘটনা ঘটে।

আদালত ১৯২৯ সালের ওয়ারশ কনভেনশন ও এর ১৯৫৫ সালের হেগ প্রোটোকল সংশোধনী অনুযায়ী রায় দেয়। এই আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো বিমান সংস্থাগুলোর দায় নির্ধারণ করে। আদালত মন্ট্রিয়াল কনভেনশন প্রযোজ্য করেনি। কারণ দুর্ঘটনার সময় (২০১৮ সালের মার্চ) নেপাল ও বাংলাদেশ কেউই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।

মন্ট্রিয়াল কনভেনশনটি ১৯৯৯ সালে গৃহীত হয়। এটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিকভাবে একীভূত ক্ষতিপূরণ কাঠামো নির্ধারণ করে। দুর্ঘটনার নয় মাস পরে নেপাল ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

নিহত ও আহতদের পরিবারের জন্য দীর্ঘ সাত বছরের আইনি লড়াই ছিল বেশ কষ্টকর।

অঙ্গিলা শ্রেষ্ঠার বাবা বিধুর মান শ্রেষ্ঠা বলেন, “সাত বছর অপেক্ষার পর অবশেষে রায় পেলাম। সন্তান মারা যাওয়ার পরও তার ন্যায্য পাওনার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। এটা খুবই বেদনাদায়ক।”

তিনি ইউএস-বাংলার প্রাথমিক ৫০ হাজার ডলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের দাবি করেছিলেন।

তার মতে, “আমরা ক্ষতিপূরণে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। কিন্তু অন্তত আমরা বিচার পেয়েছি।”

এ মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে সাতজন শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষে মামলা দায়েরকারী আইনজীবী অমৃত খারেল বলেন, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বিমার অর্থকেই পুরো ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখিয়ে পরিবারগুলোকে বিভ্রান্ত করেছিল।

তিনি বলেন, “বাস্তবে বিমার এই অর্থ যাত্রীরা টিকিট কাটার সময়ই দিয়ে দেয়। এটা কোম্পানির নিজস্ব খরচ নয়।”

আইনজীবী খরেল আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, বিমা ও ক্ষতিপূরণ দুটি আলাদা আইনি বিষয়। গাফিলতি বা ইচ্ছাকৃত অবহেলার প্রমাণ থাকলে ক্ষতিপূরণই প্রকৃত বিচার নিশ্চিত করে, যা বিমা কাভার করতে পারে না।

তার মতে, “ইচ্ছাকৃত অবহেলা ও গাফিলতির জন্য বিমান সংস্থার পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক। এটি নেপালের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক জয়। প্রথমবারের মতো যাত্রীপক্ষ জয়লাভ করেছে। এটি মানবাধিকারের এক বড় বিজয়।”

তিনি এই রায়কে একটি দৃষ্টান্তমূলক রায় হিসেবে আখ্যা দেন, যা বিমান সংস্থার দায়বদ্ধতা নিয়ে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারে।

“এই রায়ের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বার্তা পৌঁছেছে, নেপালেও আইনি প্রতিকার পাওয়া সম্ভব”, বলেন আইনজীবী খরেল।

আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এই মতের সঙ্গে একমত। তাদের মতে, এই রায় ভবিষ্যতে বিমান দুর্ঘটনার ভুক্তভোগীদের সীমাহীন ক্ষতিপূরণের দরজা খুলে দিল।

তারা আরও বলেন, বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণে দায়ী হওয়ার ঝুঁকি থাকলে বিমান সংস্থাগুলো আরও বেশি নিরাপত্তা বিধান গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। উন্নত প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় কঠোর মানদণ্ড অনুসরণ করবে।

কী হয়েছিল সেদিন

ঘটনাটি ২০১৮ সালের ১২ মার্চের।

ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুগামী নির্ধারিত ইউএস-বাংলা ফ্লাইটটি ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ভুল পথে চলে যায় এবং রানওয়ের বাইরে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে যায়। ৭৬ আসনের বোম্বার্ডিয়ার কিউ৪০০ বিমানটি আগুনে পুড়ে যায়; ঘটনাস্থলেই ৫১ জন মারা যান।

নিহতদের মধ্যে ছিলেন ২২ জন নেপালি, ২৮ জন বাংলাদেশি ও একজন চীনা নাগরিক। এটি ছিল একটি বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং বোম্বার্ডিয়ার কিউ৪০০ মডেলের জন্যও সবচেয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

প্রায় সাত বছর ধরে চলা এই মামলার শেষে আদালত সিদ্ধান্তে আসে যে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স একটি সচল উড়োজাহাজ পরিচালনায় মারাত্মক গাফিলতি করেছে। এটি দুর্ঘটনার মূল কারণ।

কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটিতে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের সঙ্গে সহকারী পাইলট হিসেবে ছিলেন পৃথুলা রশিদ। তারা দুজনই এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে পৃথুলা রশিদ দুর্ঘটনার সময়ই প্রাণ হারান। আর নেপালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ সুলতান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত