‘সিংহ দরবার’, নেপালে জেন জিদের বিক্ষোভের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি শতবর্ষী এই প্রাসাদও। রাজতান্ত্রিক নেপালের এই রাজপ্রাসাদ প্রজাতান্ত্রিক নেপালে শাসনকাজ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে।
নেপালে নির্বাহী বিভাগের প্রধান দপ্তর রাজধানী কাঠমান্ডুর এই প্রাসাদেই, মন্ত্রণালয়গুলোর মূল দপ্তর এখানে। এখানেই বসে দেশটির পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সভা।
সোশাল মিডিয়া বন্ধের পর তরুণ প্রজন্মের সহিংস বিক্ষোভে গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির পদত্যাগের পর যে কয়েকটি সরকারি দপ্তরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে সিংহ দরবার একটি।
নেপালে রানা রাজবংশ যখন ক্ষমতায়, তখন ১৯০৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসের তার বাসভবন হিসাবে সিংহ দরবার প্রাসাদটি তৈরি করেন। এর নকশা করেছিলেন দুই নেপালি স্থপতি, কুমার নরসিংহ রানা এবং কিশোর নরসিংহ রানা। তখন এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৫০ লাখ রুপি।
লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রভাষক ঋষি রাম পারাজুলির গবেষণা অনুসারে, মূলত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এবং প্রশাসনিক শাসন কেন্দ্র হিসাবে ৫০ হেক্টর সুসজ্জিত বাগান এবং সাতটি আঙিনা নিয়ে প্রসাদটি নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদটিতে রয়েছে ১ হাজারের বেশি কক্ষ।
সিংহ দরবার শুধু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম প্রাসাদ হিসাবেই পরিচিত নয়, এটি রানা শাসনের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক হয়ে ছিল এক সময়।
১৯৫১ সালে রানারা ক্ষমতা হারানোর পর নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের নেপালে সিংহ দরবার নির্বাহী বিভাগের দপ্তর হিসাবে ব্যবহার হতো। এক যুগ আগে গণতান্ত্রিক নেপাল প্রতিষ্ঠার পর সিংহ দরবারের ভূমিকা একই থাকে। রেডিও নেপাল ও নেপাল টেলিভিশনের দপ্তরও এখানেই।
১৯৭৩ সালের ৯ জুলাই এই প্রাসাদে ভয়াবহ আগুন লাগে। সেই অগ্নিকাণ্ড এখনও রহস্যময় হয়েই রয়েছে। মধ্যরাতে লাগা সেই অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।
ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটির রত্ন রাজ্য ক্যাম্পাসের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান জগৎ নেপাল বলেন, আগুনের সেই রাতের সঙ্গে অনেক গল্প ও জল্পনা মিশে আছে এখনও।
তখন ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন সূর্য প্রসাদ শ্রেষ্ঠা, যিনি পরে নেপালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। তার একটি বক্তব্য এই অগ্নিকাণ্ড নিয়ে রহস্যের জাল ছড়ায়।
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে সিংহ দরবার প্রাঙ্গণে কিছু গাড়ি রাখার জন্য একটি ‘অস্বাভাবিক’ আদেশ পাওয়ার কথা বলেন সূর্য প্রসাদ। এর আগে তিনি কখনও এমন নির্দেশ পাননি। তাই তিনি সেই আদেশ না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সূর্য প্রসাদ বিশ্বাস করেন, যদি তিনি সেই আদেশ মেনে নিতেন, তাহলে তার গাড়িটি আগুনে আরও বেশি ইন্ধন জোগাত, যা অগ্নিকাণ্ডকে আরও ধ্বংসাত্মক করে তুলত।
এই ঘটনাটি একটি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে, যা থেকে বোঝা যায় যে কেউ হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগিয়েছিল।
তখন নেপালের রাজা ছিলেন বীরেন্দ্র বীরবিক্রম সাহা দেব। আগুন যখন লাগে, তিনি তখন গভীর ঘুমে। রাতভর আগুন জ্বললেও কেউ তাকে তা জানায়নি। কারণ প্রথা অনুসারে, একবার রাজা রাতে বিশ্রাম নিতে গেলে তাকে বিরক্ত করা অনুচিৎ ছিল।
ফলে রাজা বীরেন্দ্র পরদিন সকালে এই ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানতে পারেন। ততক্ষণে আগুন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে ফেলেছে।
সিংহ দরবারে কর্মরত কর্মচারী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কীর্তি নিধি এবং মন্ত্রীরা সেদিন রাতে আগুন নেভাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর মাত্রা ছিল অপ্রতিরোধ্য। মূল্যবান জিনিসপত্র প্রায় কিছুই রক্ষা করা যায়নি।
জগৎ নেপাল বলেন, “শের বাহাদুর শাহী নামে একজন ব্যক্তিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই দায়িত্ব একজন ব্যক্তির জন্য অনেক বেশি ছিল।”
তাই এই বিপর্যয়ের পেছনের সত্য কোনোদিনই উন্মোচিত হয়নি।
আগুনের পরের পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। অফিসগুলো সরাতে হয় এবং সরকারের কাজেও বিঘ্ন ঘটে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কয়েক বছর লেগে যায় নেপালের।
জগৎ নেপাল বলেন, সিংহ দরবারের কিছু অংশ সংস্কার এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করতে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ বছর সময় লেগেছে। তবে এই ক্ষতি কেবল কাঠামোগত ছিল না, উত্তরহীন প্রশ্ন, ষড়যন্ত্র এবং পুনর্গঠনের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের একটি ধারা রেখে যায়।
সেই আগুনের ধ্বংস থেকে দাঁড়ানো সিংহ দরবার পুনরায় আক্রান্ত হলো ৫২ বছর পর। গত ৯ সেপ্টেম্বর জেন জি বিক্ষোভের সময় সিংহ দরবারে অগ্নিসংযোগ আধুনিক নেপালে ঐতিহাসিক অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলোর একটি ঘটিয়েছে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল একটি স্থাপত্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং দেশের ইতিহাস এবং শাসনের মূলে আঘাত করেছে। অনেক নেপালি এই ক্ষতি গভীরভাবে অনুভব করছেন।
“যখন রাজনীতিকরা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন, তখন জাতিকে তার মূল্য দিতে হয়। সেই মূল্যই এখন নেপাল দিচ্ছে,” মন্তব্য করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ কাশিরাজ দাহাল।
তার কথাগুলো তুলে ধরে যে এই আগুন কেবল একটি কাঠামোর ধ্বংস নয়, গভীর রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন, যা বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠান এবং শাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
এই ক্ষতি এমন এক সময় ঘটল, যখন নেপাল ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টার এক দশক পূর্ণ করেছে।
ভূমিকম্পের পর সিংহ দরবারকে ঠিকঠাক করতে নেপালকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল এবং এটিকে পুনরায় কার্যক্ষম করতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল।
এবারের আগুনে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।
সেই ক্ষতির সঙ্গে আরেকটি দিকে আলোকপাত করেন ইতিহাসবিদ জগৎ নেপাল। ২০১৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি সফরের সময় তিনি দেখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়টি কেবল তাদের আর্কাইভ তৈরির জন্যই ১৬০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছিল। নথিগুলো জলরোধী এবং আগুন-প্রতিরোধী স্থানে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা জগৎ নেপালকে বলেছিলেন, “যদি এই কাগজপত্রগুলো হারিয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস হারিয়ে যাবে।”
তিনি বিশ্বাস করেন যে ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণে নেপালেরও আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা থাকা উচিৎ, সেগুলোকে পানি ও আগুন প্রতিরোধী করে তোলা উচিৎ, যাতে সঙ্কটের মুহূর্তে ইতিহাস মুছে না যায়।
এবারের ধ্বংসযজ্ঞের জন্য তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন জিদের দোষারোপ করতে চাইছেন না সংবিধান বিশেষজ্ঞ দাহাল। তিনি অব্যবস্থাপনা ও সুবিধাবাদী মনোভাবকে দায়ী করেছেন।
তবে তিনি বলেন, “কেউ কেউ জেন জি-এর প্রতিবাদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।”
দাহাল মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ হবে সিংহ দরবার পুনর্গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ঐতিহ্য ও নির্মাণ রীতি ধরে রেখে প্রাসাদটি পুনরায় গড়ে তোলা।
সিংহ দরবার কেবল ইট-বালু নয়, এটি নেপালের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক বলে মনে করেন তিনি। নেপালের ইতিহাসের জীবন্ত এই প্রতীককে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণে জোর দেন তিনি।
তথ্যসূত্র : কাঠমান্ডু পোস্ট