জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সরাতে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের তৎপরতার খবর যখন চাউর হচ্ছে, তখন মহাসচিব পাল্টে ফেললেন তিনি।
মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব করা হয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সচিব খন্দকার দেলোয়ার জালালী।
ফেইসবুকে এক পোস্টে তিনি ‘ব্রেকিং নিউজ’ দিয়ে লিখেছেন, “ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে নিয়োগ দিয়েছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।”
এরপর শামীম পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, “মহাসচিবের দায়িত্ব জাতীয় পার্টির মাননীয় চেয়ারম্যান আমার ওপর অর্পণ করেছেন। সেজন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
“আমরা তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে দল পরিচালনা করব। আমরা জেলা পর্যায়ে যাব, উপজেলা পর্যায়ে যাব, জাতীয় পার্টিকে রিভাইব করব।”
সাবেক সংসদ সদস্য শামীম পাটোয়ারী টিভি আলোচনা অনুষ্ঠানের পরিচিত মুখ।
এবিষয়ে চুন্নুর কোনও প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তিনি ২০১৪ সালের শেখ হাসিনার সরকারে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
মহাসচিবের পদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সদস্যপদও হারিয়েছেন চুন্নু। দলটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, চুন্নু, জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে প্রাথমিক সদস্যসহ দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জি এম কাদের।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে দলের চেয়ারম্যানকে মহাসচিবসহ সব নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ঘনঘন এই ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতেন। তার মৃত্যুর পর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া ভাই জি এম কাদেরও একই পথে হাঁটছেন।
শামীম পাটোয়ারীএতদিন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। পাশাপাশি অতিরিক্ত মহাসচিবের দায়িত্বও পালন করছিলেন তিনি।
জিয়াউদ্দিন বাবলুর মৃত্যুর পর ২০২১ সালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে চুন্নুকে বসিয়েছিলেন কাদের। সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুন্নু তার আগে দলটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় পার্টিও দুঃসময় পার করছে। আওয়ামী লীগ আমলের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে অভ্যুত্থানকারীরা ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দিয়ে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি জি এম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে হামলাও হয়েছিল।
তার মধ্যে জাতীয় পার্টিতেও বিরোধ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলের এক সভায় গত ২৮ জুন সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তা স্থগিত করেন চেয়ারম্যান কাদের।
সেই সিদ্ধান্তে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই নাখোশ হয়ে চেয়ারম্যানকে সরানোর পরিকল্পনা করছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর আসে। তার মধ্যেই মহাসচিব পাল্টে ফেললেন তিনি।
সামরিক শাসক এরশাদ গত শতকের ৮০ এর দশকে ক্ষমতা নিয়ে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর দলের মহাসচিব করেছিলেন ডা. এম এ মতিনকে। জিয়া ও আব্দুস সাত্তারের সরকারের এই মন্ত্রী জাতীয় পার্টির মহাসচিব পদে তিন বছর ছিলেন।
এরপর মতিনকে সরিয়ে এডভোকেট মাহবুবুর রহমানকে করা হয় মহাসচিব। তিনি তখন মন্ত্রী ছিলেন। অল্প কিছুদিন পর তখনকার মন্ত্রী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসানকে মহাসচিব করেন এরশাদ।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের আগে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনকে মহাসচিব পদে এনেছিলেন এরশাদ।
এরশাদ কারাগারে থাকার মধ্যেই শাহ মোয়াজ্জেমকে সরিয়ে যশোরের খালেদুর রহমান টিটোকে মহাসচিব করেন। ১৯৯৫ সালে আবার কারাগার থেকেই টিটোকে সরিয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মহাসচিব করেন এরশাদ।
তিনি কারামুক্ত হওয়ার পর ১৯৯৭ সালে মঞ্জুকে সরিয়ে নাজিউর রহমান মঞ্জুরকে মহাসচিবের পদে বসান। ২০০১ সালে মঞ্জুরকেও বাদ দেন। মহাসচিব পদে বসানো হয় সাবেক জাসদ নেতা এ বি এম শাহজাহানকে।
দুই বছর পর ২০০৩ সালে মহাসচিব পদ পান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনি দীর্ঘদিন এই দায়িত্বে ছিলেন।
দশম সংসদ নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে অংশগ্রহণের পর ২০১৪ সালে হাওলাদারকে বাদ দিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেন এরশাদ।
এরপর স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে ভাই কাদেরের দ্বন্দ্বের মধ্যে বাবলুকে সরিয়ে হাওলাদারকে মহাসচিব পদে ফিরিয়ে আনেন এরশাদ।
এরশাদের মৃত্যুর পর দলের মধ্যে রওশন ও কাদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। এক পর্যায়ে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তাদের বিরোধ মীমাংসা হয়, তাতে দলের চেয়ারম্যান হন কাদের, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন।
তবে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে গিয়েও বিপর্যয়কর ফলের জন্য নেতা-কর্মীদের রোষের মুখে পড়তে হয় কাদের ও চুন্নুকে।